সময়ের জনমাধ্যম

ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা: বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট

Last Updated on 11 hours by admin

মোহাম্মদ এন. হক, জৌষ্ঠ বার্তা সম্পাদক, জাজিরা নিউজ: আন্দোলন, অভ্যুত্থান কিংবা বিদ্রোহ—এগুলো কখনই পুরোপুরি অরাজনৈতিক হয় না। ইতিহাসের পাতায় পাতায় দেখা যায়, যেখানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাবের ছাপ স্পষ্ট। যদিও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো আন্দোলন বা অভ্যুত্থান সফল হতে পারে না, তথাপি এই সফলতার পেছনে রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্বের ভূমিকা অপরিসীম। অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি করে, তবু সেখানে রাজনৈতিক স্বত্বার উপস্থিতি এবং তাদের সক্রিয়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই সত্যটি সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতি থেকে দূরে ছিল। কিন্তু এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, যুদ্ধের মূল পরিকল্পনা, সাংগঠনিক নেতৃত্ব, এবং সফলতার নকশা সবকিছুই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাতেই ছিল। এমনকি অনেক রাজনৈতিক কর্মীই সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক সচেতনতা এবং নেতৃত্ববোধ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের মতো বড় সংগ্রাম সম্ভব হতো না।

এভাবে যদি আমরা বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের কোনো আন্দোলন বা অভ্যুত্থানের দিকে তাকাই, দেখা যায় একই ধরনের চিত্র। বিশেষ করে, ২০২৪ সালের সম্ভাব্য রাজনৈতিক অভ্যুত্থানটি তার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এই অভ্যুত্থানের মূল শক্তি ছিল ছাত্র-জনতা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় ভূমিকা এখানে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। ছাত্রদের অরাজনৈতিক ভূমিকা সফলতা অর্জনে সহায়ক হলেও রাজনৈতিক দল এবং নেতৃবৃন্দের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিটি আন্দোলন বা অভ্যুত্থানের পেছনে এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে। এরা হয়ত প্রকাশ্যে না এসে নির্দিষ্ট প্রভাব বিস্তার করে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা বা বিক্ষোভ জাগিয়ে তোলে। তবে এর মানে এই নয় যে, যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে বা আন্দোলনের সংগঠক তারা সবাই রাজনৈতিক কর্মী। অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, সমন্বয়কারীদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসেন। তবে এটি খারাপ কিছু নয়, বরং এতে আন্দোলনের পরিকল্পনা ও রূপায়ণে এক ধরণের শৃঙ্খলা এবং গতিশীলতা আসে।

রাজনীতি থেকে পুরোপুরি মুক্ত কোনো আন্দোলন বাস্তবে খুব কমই দেখা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গন সবসময়ই আন্দোলন ও বিদ্রোহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, এমনকি সাম্প্রতিক সময়ের কোটা সংস্কার আন্দোলন বা সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা ছাত্রনেতারা একাধিকবার এসব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। তাই রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার পরিবর্তে এটিকে একটি স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় অংশ হিসেবে দেখা উচিত।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে দেখা যায় যে, অনেক সময় অরাজনৈতিক আন্দোলনও রাজনীতির মধ্যে গিয়ে মিশে যায়। বিশেষ করে যখন আন্দোলন বা অভ্যুত্থানটি একটি বড় সামাজিক সমস্যা নিয়ে শুরু হয়। এ ধরনের আন্দোলন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। রাজনৈতিক দলগুলো এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। তারা সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভের জন্য বিভিন্ন রকম পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণ করে, যা আন্দোলনের ধারাকে পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা, আর এটাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশে ছাত্রদের অংশগ্রহণ নিয়ে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা উঠে আসছে। তবে এই ব্যাখ্যার পেছনে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। এমনকি ছাত্র-জনতার মধ্যে থেকেও অনেকেই রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে। সুতরাং, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রেও সমন্বয়কারীদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা স্বাভাবিক। এটিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখার কিছু নেই। বরং এটি রাজনৈতিক আন্দোলনের শৃঙ্খলা এবং নেতৃত্ব প্রদান করে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো সবসময়ই সমাজের বৃহত্তর পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়। এখানেই রাজনৈতিক সচেতনতা এবং নেতৃত্বের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই নেতারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের চিন্তাধারা এবং মতামতকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। তাই, রাজনৈতিক প্রভাবকে অস্বীকার না করে, এটিকে একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রত্যেকেই সমাজের পরিবর্তন আনতে কাজ করে। এভাবেই আন্দোলন ও অভ্যুত্থানগুলো তাদের পূর্ণতা লাভ করে। রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক সক্রিয়তার মেলবন্ধনই একটি আন্দোলনকে সফল করে তুলতে পারে। সুতরাং, ভবিষ্যতের যেকোনো বড় আন্দোলনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বত্বার সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরিবর্তে এটিকে আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত।

উপসংহার:

রাজনীতি এবং অরাজনৈতিক অংশগ্রহণের মেলবন্ধনেই প্রতিটি সফল আন্দোলনের ভিত্তি। শুধুমাত্র অরাজনৈতিক অংশগ্রহণ দিয়ে একটি বড় আন্দোলনকে সফল করা কঠিন। রাজনৈতিক স্বত্বা এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই আন্দোলন, অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহের সফলতা আসে। ২০২৪ সালের সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক স্বত্বার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।