Last Updated on 1 year by zajira news
নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: আজ মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। বঞ্চিত খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষদের অধিকার আদায়ের ইতিহাস ১৩০ বছর পেরুল। হাজার বছরের বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এদিন বুকের রক্ত ঝরিয়েছিলেন শ্রমিকেরা।
শ্রম ঘণ্টা কমিয়ে আনার দাবিতে এদিন শ্রমিকরা যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। সে ডাকে শিকাগো শহরের তিন লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখেন।
ন্যায্য অধিকার আদায়ে ১৮৮৬ সালের মে মাসে আমেরিকার শিকাগো শহরের রাজপথ শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। ১৮৮৬ থেকে ২০২৪। কেটে গেছে শ্রমের মর্যাদা, মূল্য ও ন্যায্য মজুরি শুধু নয়, যুক্তিসংগত কর্ম সময় নির্ধারণের আন্দোলনের ১৩৮ বছর। এ সময় পরিবর্তন হয়েছে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার। আর সভ্যতার কারিগর শ্রমিকরাই। যুুগে যুগে তাদের অবদান তাই অনস্বীকার্য। দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দিতে শ্রমিকের সহযাত্রী হয়েছিল দেশ-বিদেশের অসংখ্য শ্রমিক সংগঠন।
১ মে পৃথিবীর ৮০টি দেশে মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বার্থরক্ষায় এ দিনে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়। এ দিনে শ্রমিকদের নিয়ে যারা ভাবেন, তারা স্মরণ করেন ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কয়ারে ঘটে যাওয়া করুণ কাহিনির।
যদিও এই করুণ কাহিনির সূত্রপাত হয়েছিল আরও আগে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ইংল্যান্ডের সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজ সংস্কারক রবার্ট ওয়েন সর্বপ্রথম শ্রমিকদের আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা মনোরঞ্জন এবং আট ঘণ্টা বিশ্রামের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কিন্তু দ্রুত শিল্পায়ন আর অধিক মুনাফার জন্য শিল্পমালিকরা শ্রমিকদের কাজের কোনো সময় বেঁধে দিতে রাজি ছিলেন না। এ সময় শ্রমিকরা সপ্তাহের ছয় দিনে দৈনিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা, এমনকি তারও বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য হতো। তাই শ্রমিক সংগঠন এবং প্রতিবাদী শ্রমিকরা সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে ইউরোপজুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। শিল্পসমৃদ্ধ আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৮৬ সালের এপ্রিল শেষে এই আন্দোলন প্রবল গতি লাভ করে। এর দুই বছর আগে ১৮৮৪ সালের অক্টোবরেই আমেরিকার ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার ইউনিয়ন সময় বেঁধে দিয়েছিল ১ মে ১৮৮৬ তারিখের মধ্যে আট ঘণ্টা শ্রমের বিষয়টিকে মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এর সমর্থনে ১ মে ১৮৮৬ আমেরিকাজুড়ে হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি দেওয়া হয়। প্রথম তিন দিনে মিছিল আর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে আমেরিকার শিকাগো শহর।
কী ঘটেছিল সেদিন?
১৩৮ বছর আগে, ১৮৮৬ সালের ৪ মে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ইংরেজি এবং জার্মান ভাষায় লেখা একটি লিফলেট প্রকাশিত হয়। তাতে বড় অক্ষরে লেখা- ‘ওয়ার্কিংম্যান, টু আর্মস’। লিফলেটের মাধ্যমে শ্রমিকদের শিকাগো শহরের হে মার্কেট চত্বরে জড়ো হতে বলা হয়। তার আগের দিন ‘ম্যাককরমিক রিপার্স’ কারখানায় এক জার্মান অভিবাসী শ্রমিক নেতা অগাস্ট স্পাইস বিক্ষোভকারীদের ডাকা হরতাল ও বিক্ষোভে অসংখ্য হত্যাকান্ড দেখেন। যা দেখে তিনি দৌড়ে তার অফিসে যান এবং লিফলেট ছাপান। বলে রাখা ভালো- স্পাইস নিজে একটি জার্মান সংবাদপত্র চালাতেন। হত্যার খবর এবং লিফলেট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ‘হে মার্কেট চত্বর’ ছিল শহরের একটি ব্যস্ত অংশ। যেখানে ছিল যাত্রীছাউনি, অসংখ্য গাড়ির দোকান এবং কাছাকাছি বেশ কয়েকটি কারখানা।
সেদিন হালকা বৃষ্টি উপেক্ষা করে মিছিল বের করে আন্দোলনত শ্রমিকরা। রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ দুই হাজারের বেশি অভিবাসী শ্রমিক হে মার্কেট চত্বরে জড়ো হয়। এরপর হে মার্কেট চত্বরে শুরু হয় বক্তৃতা পর্ব। ওই সময় শেষ বক্তা হিসেবে ভাষণ দেন আমেরিকার সমাজ সংস্কারক ও শ্রমিক নেতা স্যামুয়েল ফিলডেন। যদিও দিনটি ছিল ঠান্ডার। তাপমাত্রার পারদ ছিল ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু তার উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা বাতাস ভারী করে তোলে। তাতে সমর্থন দেয় শ্রমিকেরা। রাত সাড়ে ১০টায় তার বক্তৃতা শেষ হতেই এগিয়ে আসে পুলিশ বাহিনী এবং সভাস্থল ছেড়ে সবাইকে চলে যেতে হুকুম দেয়। এমনি এক মুহূর্তে পুলিশের এগিয়ে আসা পথে ঘরে তৈরি একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই এক পুলিশ সদস্য নিহত হন। আহত হন আরও ৬৬ জন। যার মধ্যে ছয়জন পুলিশ সদস্য পরবর্তী সময়ে মারা যান। অন্যদিকে বোমা বিস্ফোরণের পর উভয়পক্ষে গুলিবিনিময় শুরু হয় বলে পুলিশ দাবি করলেও ঐতিহাসিকদের মতে, এ সময় পুলিশই শ্রমিকদের ওপর গুলি ছোড়ে এবং নিজেদের গুলিতেই তারা মারা যায়। মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে যায় হে মার্কেট চত্বর, রাস্তায় পড়ে থাকে শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ। যদিও বলা হয় এতে চারজন শ্রমিক নিহত এবং ৬০ জন আহত হন।
প্রকৃত সত্য অনেকটাই আড়ালে ঢাকা পড়ে। কিন্তু আড়ালে থাকে না তথাকথিত বিচারকাজ। আন্দোলনকারী শতাধিক শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় বিচারের পালা। বিচার শেষে জুরি বোর্ড আট প্রতিবাদীকে মৃত্যুদন্ড প্রদানের পক্ষে মত দিলেও বিচারক সাতজনকে মৃত্যুদন্ড এবং একজনকে ১৫ বছরের কারাদন্ড প্রদান করেন। উচ্চ আদালতও একই রায় বহাল রাখে। আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ইলিনয়ের গভর্নর রিচার্ড জেমস প্রতিবাদী শ্রমিক নেতা ফিলডেন এবং স্ত্রোয়ারের মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে ১০ নভেম্বর ১৮৮৭ যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেন। এরপর শুরু হয় বাকি পাঁচজনের মৃত্যুর প্রহর গোনার পালা। কিন্তু এ দিনই ঘটে আরেক বিষাদময় ঘটনা।
লিঞ্জ নামের এক সাজাপ্রাপ্ত বিপ্লবী শ্রমিক কৌশলে চুরুট বা মোটা সিগারেটের মতো দেখতে বিশেষ ধরনের হাতে তৈরি বোমা (ব্লাস্টিং ক্যাপ) সংগ্রহ করেন। চুরুটের মতোই তা মুখে পুরে তিনি এতে বিস্ফোরণ ঘটান। মুহূর্তেই লিঞ্জের মুখের বিরাট অংশ আলগা হয়ে খসে পড়ে। তারপরও ছয় ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন লিঞ্জ। পরদিন ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর অবশিষ্ট চার বিপ্লবী শ্রমিক এঞ্জেল, ফিসার, পারসন্স এবং স্পাইসকে নেওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে। ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগোতে এগোতে তারা শ্রমিকদের অধিকারের কথা নিয়ে রচিত গণসংগীত ও বিপ্লবী গান গেয়ে যান। ফাঁসিতে ঝোলানোর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে স্পাইস বলে যান, ‘এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের নীরবতা (মৃত্যু) তোমরা যে কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চাও, তার চেয়েও শক্তিশালী হবে।’ বৃথা যায়নি শ্রমিক নেতা স্পাইসের গর্জন।