Last Updated on 1 month by zajira news
নিজউ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: মানুষের অবিবেচক-অবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সৃষ্টি হচ্ছে ডুবোচর। সেই চরে বাধা পেয়ে ইলিশ যাচ্ছে ভিন্ন পথে। ডিম ছাড়ছে ‘অন্য বাড়িতে’। সেই ডিম ফুটে বের হওয়া ছানাপোনারা খাবারের খোঁজে এসে জড়ো হচ্ছে ডুবোচরগুলোয়। সে সাথে অন্য মাছের পোনারাও আসছে ।
তখন আবার সেই মাছের লোভে দলে দলে ছুটে আসেন অসাধু মৎস্য কারবারিদের ভাড়াটে জেলেরা। তাঁরা বাছবিচার ছাড়াই মেতে ওঠেন মাছ শিকারে। ক্ষতিকর নিষিদ্ধ জাল ফেলে ডুবোচরে ও আশপাশের নদীতে আশ্রয় নেওয়া ধরা নিষিদ্ধ এমন সব ছোট মাছ ধরে নিয়ে যান। সঙ্গে বড় ও মাঝারি মাছও ধরা পড়ে। ওই জালে আরও ধরা পড়ে অন্যান্য প্রজাতির মাছ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের রেণু-পোনা। জালে আটকে সেগুলো অকালেই মারা পড়ে। রেহাই পায় না চাপিলা-জাটকা-ছোট আকারের ইলিশও। সেগুলো ধরে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় আড়তদারের হাতে।
বিশেষজ্ঞদের মুখে আরও অনেক রকমের অঘটনের কথা শোনা যাবে । দেখা যাবে সরেজমিন ঘুরলে।
মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, কয়েক বছর ধরে ভরা মৌসুমে নদীতে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ উঠছে না। এর প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের বৃষ্টির ব্যাকরণ বদলে যাচ্ছে। বর্ষার বড় সময়জুড়ে বৃষ্টি থাকছে না, আবার হঠাৎ হঠাৎ অনেক বৃষ্টি হচ্ছে।
আষাঢ়ের শুরু থেকে (এপ্রিল-মে) যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়, তাহলে ইলিশের পেটে ডিম আসত। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। পেটে ডিম না এলে ইলিশ সাগর থেকে নদীতে উঠবে না। অতিরিক্ত খরা, অনাবৃষ্টি, প্রচণ্ড গরম, পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা অস্বাভাবিক হলেও ইলিশের পেটে ডিম আসে না। এর সঙ্গে নদীর স্রোত ও পানির গভীরতাও সম্পর্কিত। নদীর পানি ডিম ছাড়ার উপযুক্ত হলে ইলিশই বোঝে যে তার নদীতে ওঠার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তবে বৃষ্টি অতিরিক্ত হলেও ইলিশের ক্ষতি নেই।
মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, নদী থেকে সাগর, সাগর থেকে নদী—ইলিশের চলাচলের পথ (মাইগ্রেটরি রুট) ভরাট হয়ে গেছে; ডুবোচর পড়েছে। ইলিশের পথ যদি আটকে যায়, তাহলে সে উঠবে কীভাবে? আবার ইলিশ ওঠার জন্য কমপক্ষে ১০-১২ ফুট গভীর পানি দরকার। কিন্তু মোহনার পথে পলি পড়ে ভরাট হয়ে পানির গভীরতা কোথাও কোথাও ৪-৫ ফুটও হয়েছে।
জেলেরাও জানান, সাগরমোহনার গ্যাসফিল্ড নামক স্থান থেকে উত্তরে চাঁদপুর পর্যন্ত মেঘনা নদীজুড়ে অসংখ্য ডুবোচর পড়েছে। তেঁতুলিয়া নদীরও একই অবস্থা। তাদের দাবি, এসব ডুবোচরের কারণে নদীতে ইলিশ কম উঠছে।
ইলিশের জাটকা-পোনা, ছোট ছোট মাছ ও বাচ্চারা ৩-৪ ফুট পানিতে থাকে। গভীর পানির চাপ সহ্য করতে পারে না। তাই জোয়ারের সময় খাবারের সন্ধানে বাচ্চাগুলো ডুবোচরে আশ্রয় নেয়।
মোল্লা এমদাদুল্যাহ, প্রকল্প পরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা
গত ৬ জুন চরফ্যাশনের ঢালচর ইউনিয়নের ফরেস্ট বাজারে ১০-১২ জন প্রবীণ জেলের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, আগের বর্ষাকাল আর এখনকার বর্ষাকালে অনেক পার্থক্য। এখন সেই পরিমাণ মেঘ, বৃষ্টি, তাপমাত্রা নেই। বৃষ্টি হলেও অসহ্য গরম।
ঢালচরের মো. শামসুল হক মাঝি (৭২) এখনো সাগরমোহনায় গিয়ে মাছ শিকার করেন। তিনি বলেন, আগে আষাঢ়ের শুরুতেই বৃষ্টি হতো। সেই বৃষ্টি চলত আশ্বিন মাস পর্যন্ত। বৃষ্টির কারণে নদীর পানির লবণাক্ততা কমে পানি মিষ্টি হতো। আবহাওয়ায় একটা ঠান্ডা ভাব ছিল। এখন ভরা বর্ষায় বৃষ্টি কম, বর্ষার শেষ সময়ে তুমুল বৃষ্টি। এতে লবণাক্ততা কমছে না। এসব কারণেই নদীতে ইলিশ উঠছে না। তাঁর সঙ্গে অন্য জেলেরাও একমত প্রকাশ করেন।
সেখানে ২০-২২ জন জেলে পিটানো জাল টেনে মাছ শিকার করছেন। একই লোঙ্গায় গত শুকনো মৌসুমেও মদনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন ও ধনিয়ার ইউপি সদস্য মনিরুল ইসলামের নিয়োজিত জেলেদের পাইজাল টেনে মাছ শিকার করতে দেখা গেছে। এসব পিটানো জাল ও পাইজালে মাছ শিকার নিষিদ্ধ।
দেখা যায়, এসব জালে যে মাছ ধরা পড়ছে, তার বেশির ভাগই জাটকা ও ছোট ইলিশ। সঙ্গে অন্য মাছের রেণুপোনা আছে। বড় মাছ খুব কম।
জেলেরা জানান, নদীতে তাঁরা সাধারণত কম পানিতে বেহুন্দি পাতেন। কিন্তু সাগরমোহনায় ৬ বাম (এক বামে ৪ হাত) থেকে ২৫ বাম পানির মধ্যেও বেহুন্দি জাল পাতছেন। তাহলে মাছ নদীতে ঢুকবে কীভাবে?
স্থানীয় জেলেরা জানান, যদি কখনো জেলেরা গভীর পানিতে ইলিশজাল (ছান্দিজাল) পাতে, আর সেই জাল যদি ভাসতে ভাসতে অবৈধ পিটানো জালের এলাকায় যায়, তবে পিটানো জালের জেলেরা ওই সাধারণ জেলেদের ধাওয়া দেন, মারধর করেন।
বেতুয়া লঞ্চঘাট দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায়, লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের পুবের মেঘনায় ৮ নম্বর চর, মহিষার চর, সাবেক উড়িরচর ও ১২ নম্বর চর এলাকায় কয়েক কিলোমিটারজুড়ে ডুবোচর পড়েছে। এসব চরে পিটানো জাল, মশারি জাল ও খরচি জাল পাতা হচ্ছে। মশারি জালের জন্য চরের নেতাদের চাঁদা দিতে হয়। আর খরচি জাল পাতেন স্থানীয় নেতারা।
লালমোহন বাত্তিরখালে দেখা যায়, নৌকা থেকে ঝুড়ি ভরে ভরে ঘাটে জাটকা ওঠানো হচ্ছে। অন্য ছোট মাছও রয়েছে। জেলেদের জিজ্ঞেস করলে বলেন, নদী ও সাগরমোহনায় নিষিদ্ধ জাল পাতেন নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সন্দ্বীপ, হাতিয়া ও চট্টগ্রামের জেলেরা। তাঁদের কাছে সাধারণ জেলেরা ভিড়তে পারেন না। এ সমস্যা সাগরেও আছে। জেলেরা গভীর সাগরে জাল পেতে বসে থাকলে সাগরের ট্রলিং জাহাজ ইলিশ জাল ছিঁড়ে চলে যায়। কিছু বললে পাইপ দিয়ে গরম পানি মারে।
মেঘনা ও সাগরমোহনায় দেখা যায়, কিছু দূর পরপর লোহার ড্রাম, প্লাস্টিকের কনটেইনার, খুঁটির মাথা বের হয়ে আছে। এলাকাবাসী বলেন, এগুলো বিন্দিজাল, যার ভালো নাম বেহুন্দি জাল। এ জালের মুখটা হাঁ করে থাকে, যা পায় তা-ই গিলে খায়। আর ত্রিভুজাকৃতি জালের পেছনটা লেজের মতো, যার নাম দুইররা।
জেলেরা জানান, নদীতে তাঁরা সাধারণত কম পানিতে বেহুন্দি পাতেন। কিন্তু সাগরমোহনায় ৬ বাম (এক বামে ৪ হাত) থেকে ২৫ বাম পানির মধ্যেও বেহুন্দি জাল পাতছেন। তাহলে মাছ নদীতে ঢুকবে কীভাবে?
ভোলার জেলেরা বলেন, ডুবোচর, অবৈধ জাল ছাড়াও নদীতে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না ওঠার আরেক কারণ ভরা মৌসুমে মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদী থেকে বালু উত্তোলন। গত মাসের শুরুর দিকে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবিতে তাঁরা ইলিশায় বিশাল মানববন্ধন করেছেন। এর আগে অনেকবার জেলা প্রশাসনকে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে।
ভোলা জেলা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মাঝি বলেন, মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী ইলিশের প্রধান প্রজননক্ষেত্র ও নার্সারি, যেখানে ইলিশের ডিম ফুটে বাচ্চা বড় হয়, সেখানে কীভাবে বালু উত্তোলন হয়?
জানা গেছে, ইলিশের প্রজনন ও জাটকা বেড়ে ওঠার সময় বালু তোলা বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় মৎস্যসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।