Last Updated on 1 week by zajira news
অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ৮৬তম জন্মদিন আজ। তার জন্ম ২৫ জুলাই ১৯৩৯।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে ‘আলোকিত মানুষ’ তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। গুণী এই ব্যক্তিত্ব স্যার নামেই অধিক পরিচিত।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়; দেশব্যাপী আলোকিত মানুষ তৈরির এক আন্দোলনও বটে, যা দিনে দিনে আলোকিত জাতীয় চিত্তের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। মানবজ্ঞানের সামগ্রিক চর্চা এবং অনুশীলনের পাশাপাশি হৃদয়ের উৎকর্ষ ও জীবনের বহু বিচিত্র কর্মকাে র মধ্য দিয়ে উচ্চতর শক্তি ও মনুষ্যত্ব বিকশিত হওয়ার এক আয়োজন সায়ীদ স্যারের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
তিনি বলেন, পৃথিবী তো আশা দিয়ে তৈরি নয়, আশা আর নৈরাশ্য দুটো দিয়েই তৈরি। তবে আশা একটা দার্শনিক ব্যাপার। আশার ঘটনা যখন ঘটে, তখন আমরা তাকে আমাদের প্রাপ্য বলে ধরে নিই, বড় করে দেখি না, নৈরাশ্যের আঘাত যখন আসে, তখন সেটা বড় হয়েই দেখা দেয়। স্টয়িক দর্শনের কথা পাড়েন তিনি। স্টয়িক দর্শন প্রাচীন গ্রিসে উদ্ভূত। এই দার্শনিকেরা বলতে চান, সুখ আসে নিজের চিন্তা ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, বাইরের ঘটনাকে শান্তভাবে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথেও এটা আছে, অনেক জায়গায়, ‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে।’ চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি চ দুঃখানি চ। চাকার মতো, সুখ একবার নিচে যাবে, দুঃখ একবার নিচে যাবে।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, একেকবার নতুন কাজের বুদ্ধি আমার মাথায় আসে। আর আমি নবতারুণ্যে উদ্দীপিত হই। কলকাতায় জন্ম হলো, কিন্তু তাঁদের বাড়ি বাগেরহাটে, তাঁর পিতা আযীমউদ্দীন আহমদ করটিয়া কলেজে শিক্ষকতা করতেন, সেই সুবাদে করটিয়ায় এবং আরও অনেক জায়গায় তাঁর শৈশব কেটেছে। স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় বই পড়া শুরু, পাবনা জিলা স্কুলে পড়ার সময় তৈরি করেছিলেন ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি।
প্রথম আলোকে দেওয়া ‘অভিজ্ঞতার আলো’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমার সময়ে কলেজ বিল্ডিংগুলো একটু অন্ধকার অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে ছিল। কিন্তু কলেজের মধ্যে ঢুকলে মনে হতো আলো—পাখা ঝাপটানো আলো। এত উজ্জ্বলতা, এত প্রাণ! কলেজে আমি সকাল থেকে ক্লাস শুরু করতাম। যে ক্লাস পেতাম, ঢুকে যেতাম। আমি জানি যে প্রত্যেকটা ক্লাসে একজন করে শিক্ষক আছেন, যিনি প্রাণকে জাগিয়ে দিতে পারেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়বার সময়ে তিনি রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য বন্ধুদের নিয়ে তখনকার শ্রেষ্ঠ মানুষদের কাছে যান। বড় মানুষেরা উদ্যোগে যুক্ত হলে তা বিপুলভাবে পালিত হয়। পরাধীন বাঙালি স্বাধিকারের চেতনায় জেগে ওঠে। ১৯৬৮ সালে শুরু করেন পাঠচক্র। ১৯৭৮ সালে আবারও বইপড়ার চক্র শুরু হলো নক্সী কাঁথার মাঠ দিয়ে, ১০ জনে মিলে জোগাড় করেছিলেন ৩৫ টাকা ।
সেই ৩৫ টাকার কর্মসূচি থেকেই আজকের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র—সোয়া দুই কোটি ছেলেমেয়েদের কাছে এ পর্যন্ত বাছাই করা বই নিয়ে গেছে যে কেন্দ্র। এরই মধ্যে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন খ্যাতিমান মানুষ। এই পরিচয় তাঁকে সাহায্য করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজে, অর্থ সংগ্রহ কিংবা মানুষের সমর্থন আদায়ে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চলছে, এরই মধ্যে তিনি নিজেকে যুক্ত করলেন পরিবেশ আন্দোলনে। গাছ রক্ষা, নদী রক্ষা, বাতাস দূষণমুক্ত করা। প্রথম যখন ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিল ঢাকায়, তিনি পাগলের মতো কাজ করেছেন। তখনই তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বয়স বাড়ে না, কারণ নতুন নতুন কাজের ডাক আসে আর আমি নতুন উদ্যম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি।’
তাহলে আজ যে এত জগৎজোড়া দুঃসংবাদ, তা থেকে মুক্তির জন্য আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে না। অবশ্যই কাজ করে যেতে হবে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তা–ই মনে করেন। ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলনের সময় তিনি লিখলেন, ‘আমরা যেন না ভুলি যে স্বৈরাচারীরা ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে ধ্বংস হন আর গণতন্ত্রী সবাইকে ভালোবাসা দিয়ে জয়লাভ করেন।’
স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘একটা আধুনিক রাষ্ট্রে পুলিশ, সীমান্তরক্ষী, সেনাবাহিনী এমন অনেক কিছুই থাকে। এদের শক্তিও অনেক। কিন্তু এদের চেয়েও শক্তিমান একটা জিনিস থাকে প্রতিটি জাতির জীবনে। তার নাম জনগণ।
এরপর তিনি বারবার বলেছেন, ‘কোনো দিন আমাদের রাষ্ট্র ছিল না। এই প্রথম রাষ্ট্রভাবনা। আমাদের সামনে কিছুই নেই, এই প্রথমবারের মতো এটা করছি। সেটা তো খুব কঠিন হওয়ার কথা। যেসব দেশে দুই হাজার বছর, দেড় হাজার বছর, এক হাজার বছর ধরে রাষ্ট্র আছে, তাদের অবস্থা আর আমাদের অবস্থা এক নাকি? আমাদেরটা অনেক কঠিন। অনেকে খুব হতাশ হয়ে যায় যে এর মধ্যে কী করে হবে? কী করে হবে? আমি বলি যে না, এই প্রথম আমরা উঠে আসছি। আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন। সুতরাং এই ধৈর্য এবং এই সংগ্রাম আমাদের করতে হবে। গায়ের থেকে রক্তটা দিতে হবে। তা না হলে ওটা হবে না।’
আজ আমাদের মধ্যে বিষাদ, দুঃখের বাস্তবতায় আমরা বিচলিত, মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির শোকে মুহ্যমান। এই সময় শোকের পাশাপাশি আমাদের কাজ করে যেতে হবে। ২০২৪ সালের পয়লা জানুয়ারিতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা কাজ করব, কারণ কাজ মানেই অগ্রগতি। এই বিশ্বচরাচর যে এগিয়ে চলেছে, কারণ প্রতিটা গ্রহ-নক্ষত্র বিরামহীনভাবে কাজ করে চলেছে। সে যেদিকেই যাক, সে সামনের দিকেই এগোবে।’
আমাদের স্কুলগুলোকে নিরাপদ রাখা, আমাদের আকাশকে নিরাপদ রাখা, আমাদের বাতাস-নদী-বনরাজিকে রক্ষা করার জন্য আমাদের কাজ করেই যেতে হবে। একটা সুন্দর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যও আমাদের শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, ধৈর্য ধরে কাজ করে যেতে হবে। ৮৬ বছরের অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞার আলোয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তা-ই বলেন। সূত্র, প্রথম আলো