Last Updated on 9 months by zajira news
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: সম্প্রতি ফিলিস্তিনের গাজায় সংঘাতের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে ঘটে যায় একটি বড় ঘটনা। এ অঞ্চলের শক্তিধর দুই দেশ—ইরান ও ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ।
শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু না হলেও, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে কোন পরিবর্তন এসেছে ? —বিবিসির সাংবাদিক জেমস ল্যানডেল এমন প্রশ্নের ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ।
ইরান ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার পর ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী ব্যবস্থা সক্রিয় হয়। একসময় দেখা যায়, সব খবরের হেডলাইন হয়ে যায় ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে নজিরবিহীন ক্ষেপাণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা।
নীতিনির্ধারক, বিশ্লেষক ও সামরিক নেতাদের মনোযোগ এখনো পুরোনো দুই শত্রু—ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে মাত্র কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া পাল্টাপাল্টি হামলা নিয়ে। তারা যে খাদের কতটা কিনারে চলে গিয়েছিল, তা আসলেই গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করার মতো। কারণ, এই প্রথম দুই দেশ সরাসরি একে অপরের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছে।
পশ্চিমাদের কেউ কেউ ১৩ এপ্রিলের ইরানের হামলা এবং এরপর ইসরায়েলের পাল্টা হামলার মধ্যে ইতিবাচক কিছু বিষয় দেখছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, ইরানের হামলা ঠেকাতে পারাটা ছিল বড় গোয়েন্দা সাফল্য। এটি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় মিত্রদেশগুলোর সম্মিলিত সহযোগিতার এক চমৎকার উদাহরণও। এ ছাড়া ইরান ও ইসরায়েল—দুই দেশই শিখেছে কীভাবে উত্তেজনা কমিয়ে আনতে হয়। প্রথমে গোয়েন্দা সফলতার বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যাক। আমাকে বলা হয়েছিল, রোববার ভোররাতের ওই হামলার আগে বুধবার সকালে ইরানের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, পরিকল্পনা জানতে পারার কারণেই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় উপসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশকে এগিয়ে আসতে রাজি করাতে পেরেছিল মার্কিন সরকার।
ইরানের হামলা এটা দেখিয়েছে যে নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ইসরায়েল মিত্রদের ওপর কতটা নির্ভরশীল
এমিল হোকাইয়েম, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক
বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে সম্মিলিতভাবে ইরানের চালানো সবচেয়ে বড় হামলা ছিল এটি। এমনকি রাশিয়াও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে একসঙ্গে এত সমরাস্ত্র ব্যবহার করেনি। আর ১৯৯১ সালে সাদ্দাম হোসেন ইসরায়েল লক্ষ্য করে স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর এটি ছিল দেশটিতে বহিঃশত্রুর সবচেয়ে বড় হামলা।
১৩ এপ্রিল রাতে ইসরায়েলে তিন শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করে ইরান। সেগুলোর বেশির ভাগই রুখে দেওয়ার দাবি করেছে ইসরায়েল। তবে জেরুজালেমে আমার অফিস থেকে দেখেছি, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর সময় আকাশ কীভাবে আলোকিত হয়ে উঠেছিল।কোনোভাবে ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর একটি শহরের মধ্যে পড়লে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতো। যেমন পশ্চিমা এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমাকে বলছিলেন, ‘ওই সময়ে আমরা (ধ্বংসযজ্ঞের) কতটা কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম, তা ইসরায়েলের মানুষ বুঝতে পারেনি। সেদিনের গল্পটা অনেক আলাদা হতে পারত।’
সৌদি আরবের ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, দেশটি যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের হামলার বিষয়ে তথ্য দিয়েছিল। পাশাপাশি ইয়েমেন থেকে ইরানপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হুমকির দিকে নজর রেখেছিল। মোদ্দাকথা হলো, সম্মিলিত এ প্রচেষ্টা কাজে লেগেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জর্ডান ও সৌদি আরবের সামরিক বাহিনী এটা দেখিয়েছে, আকাশ প্রতিরক্ষায় তারা সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারে। ১৩ এপ্রিল রাতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসা উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ছিল সৌদি আরব ও জর্ডান। তবে সেদিন তাদের ভূমিকা কী ছিল, তা এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। জর্ডান এটা স্বীকার করেছে, নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইরানের ড্রোন ধ্বংস করেছে তারা। এটাও বোঝা গেছে যে নিজেদের আকাশসীমায় ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে তারা।
নিরাপত্তাসংক্রান্ত একটি সূত্র আমাকে বলেছে, ‘এটা ছিল একটি সফল কৌশলগত অভিযান। গোয়েন্দারা সঠিক তথ্য হাতে পেয়েছিলেন। পুরো এলাকার ওপর আমাদের নজর ছিল। আর আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। বিশ্বের অন্য দেশের জোট এটা করতে পারবে না।’ অনেকে বলছেন, এর মধ্য দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে নতুন একটি আঞ্চলিক জোটের সূচনা হতে পারে।
তবে অনেক বিশ্লেষকের কাছে এটা মনে হয়েছে, বৃহৎ রাজনৈতিক চিত্রপট এড়িয়ে শুধু প্রযুক্তিগত সফলতাটা উদ্যাপন করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো বিশ্লেষক এটাও মনে করেন যে ইরান যদি ইসরায়েলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করতে চাইত, তাহলে হামলার বিষয়ে আগে থেকে হয়তো মিত্রদের কাছে তথ্য দিত না। এ ছাড়া তাদের লক্ষ্যবস্তুর আওতা বাড়াতে পারত। হামলা চালাতে পারত দ্বিতীয় দফায়। এমনকি লেবানন থেকে হিজবুল্লাহকে বড় পরিসরে হামলা চালানোর নির্দেশও দিতে পারত তেহরান।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার বলছে, ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সক্ষমতা ও দুর্বলতাগুলো ইরানকে বুঝতে সহায়তা করেছে এ হামলা। লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক এমিল হোকাইয়েমের মতে, ইরানের হামলা এটা দেখিয়েছে যে নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ইসরায়েল মিত্রদের ওপর কতটা নির্ভরশীল। তাঁর আরেকটি প্রশ্ন হলো, আরও তীব্র সংঘাতের সময় প্রয়োজনীয় যথেষ্ট পরিমাণ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের হাতে আছে কি নেই?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার বলছে, ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সক্ষমতা ও দুর্বলতাগুলো ইরানকে বুঝতে সহায়তা করেছে এ হামলা। আর ইরানের কৌশল সম্পর্কে বড় ধারণা পেয়েছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র।
ইরান ও ইসরায়েল নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার একটি শিক্ষা পেয়েছে—এমন ধারণা মানতে নারাজ গবেষক এমিল হোকাইয়েম। তাঁর মতে, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে ইরানি রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যার ফল কী হতে পারে, তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল ইসরায়েল। তিনি বলেন, এই দুই দেশ একে অপরের সঙ্গে কথা বলে না। এর বিপরীতে তারা সামরিক তৎপরতা ও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ইঙ্গিত দেয়। বিষয়টি দ্রুতই খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে।
তবে ইরান–ইসরায়েল কোনো শিক্ষা পাক আর না পাক, অনেকেই এটা দেখেছেন, এই অঞ্চল পুরোদমে যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার কতটা কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। পশ্চিমা একজন কূটনীতিক আমাকে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে না জড়িয়ে যাওয়াটা বড় স্বস্তির বিষয় ছিল।