সময়ের জনমাধ্যম

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত উদ্বেগ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশের জন্য

Last Updated on 5 hours by zajira news

অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: ইরান-ইসরায়েলের সংঘাত বাড়তে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে বাংলাদেশের জন্যও সৃষ্টি হতে পারে কিছু ঝুঁকি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক থাকায় ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ঘিরে দেশে সংকট তৈরি হতে পারে জ্বালানি নিরাপত্তা, রপ্তানি বাণিজ্য এবং প্রবাসী আয় নিয়ে ।

১১ জুন ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় আকস্মিক বিমান হামলা চালালে এই সংঘাতের সূচনা হয়। ওই হামলায় ইরানের কয়েকজন শীর্ষ জেনারেল ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। এর পাল্টা জবাবে ইরানও ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এরপর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে।

সবশেষে, রোববার (২২ জুন) যুক্তরাষ্ট্রও এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে বিশেষ করে বিশ্বের প্রধান জ্বালানি রপ্তানির পথ হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ার আশংকা রয়েছে, যার মারাত্মক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের উপর।

বিশ্বব্যাপী সরবরাহ হওয়া জ্বালানির প্রায় ২০ শতাংশ (প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল) হরমুজ প্রণালী দিয়ে পাড়ি সরবরাহ লাইনে আসে। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ কিংবা ২০১৭ সালে সৌদি তেল স্থাপনায় হামলার সময় যেমন হয়েছিল, তেমনি যে কোনো প্রতিবন্ধকতা তেলের দামে হঠাৎ বড় অঘটন ঘটাতে পারে। বাংলাদেশ মূলত কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে, যাদের রপ্তানিও হরমুজ প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সুব্রত কুমার সাহা গনমাধ্যমকে বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম ইতোমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবো আমরা।

সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের তেলের মজুদ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে আমরা কেবল ৪৫ দিনের জ্বালানি সংরক্ষণ করতে পারি। যদি তিন থেকে চার মাসের জ্বালানি সংরক্ষণের সক্ষমতা গড়ে তোলা যায়, তা হলে কাজে আসবে।

বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের কারণে বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে। নৌপথে চলাচল বাধাগ্রস্ত হলে পণ্য পরিবহনে বিলম্ব, অর্ডার বাতিল এবং ক্রেতা হারানোর ঝুঁকি থাকবে।

বাংলাদেশি প্রবাসীদের প্রধান গন্তব্য এখনো মধ্যপ্রাচ্য। যদিও ইরান ও ইসরায়েলে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা খুব কম, তবে যুদ্ধের ব্যাপ্তি যদি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ওমানের মতো উপসাগরীয় দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা মারাত্মক হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ খান গনমাধ্যমকে বলেন, “ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ এখনো আমাদের রেমিট্যান্সে প্রভাব ফেলেনি। তবে যদি যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, তখন এটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। ”

তিনি বলেন, “যদি আমরা দেখি যুদ্ধ সৌদি, কুয়েত, কাতার, দুবাই বা ওমানে ছড়িয়ে পড়েছে, তাহলে তা দুশ্চিন্তার বিষয় হবে। কারণ, ওইসব দেশে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মরত। ব্যবসা বন্ধ হলে কিংবা কর্মসংস্থান হারালে রেমিট্যান্স কমে যাবে। ”

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়াজ-উল-ইসলামও একইভাবে বলেন, “যদি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ হবে। ”

একটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “লিবিয়ার সংকটকালে ৪০-৫০ হাজার বাংলাদেশিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) উদ্ধার করে ফিরিয়ে এনেছিল। যদি এখন এমন পরিস্থিতি হয়, তাহলে তা হবে ভয়াবহ, কারণ আমাদের অনেক মানুষ এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে। ”

তিনি আরও বলেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বাংলাদেশের বাণিজ্যেও প্রভাব পড়বে, কারণ আমদানি-রপ্তানির একটি বড় অংশ এই পথ দিয়ে সম্পন্ন হয়। “আমাদের অনেক শ্রমিকও ওই অঞ্চলে কর্মরত। তাই এর প্রভাব হবে বড়। ” ইরানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।

ইসরায়েল হামলার পর ফ্লাইট ট্র্যাকিং প্ল্যাটফর্ম ফ্লাইটরাডার২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, ইরানের ওপর দিয়ে উড়োজাহাজ চলাচল অনেক কমে গেছে, কারণ অনেক ফ্লাইট বিকল্প পথে ঘুরে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সদস্য (অপারেশনস ও পরিকল্পনা) এয়ার কমোডর আবু সাঈদ মেহবুব খান গনমাধ্যমকে বলেন, “বাংলাদেশি বিমান সংস্থাগুলো নিয়মিতভাবে ইরানের আকাশসীমা ব্যবহার করে না এবং এখনো কোনো বাংলাদেশি ফ্লাইট সমস্যায় পড়েনি। পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে শিডিউল পরিবর্তন হতেও পারে। তবে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স। ’তিনি আরও বলেন, “ইইউ ইতোমধ্যে সতর্কতা জারি করেছে এবং যাত্রীদের ইরান ও জর্ডানগামী ফ্লাইট না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। ”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী গনমাধ্যমকে বলেন, “বিশ্ব এখনো তেলের ওপর নির্ভরশীল, আর ইরান বিশ্ব রিজার্ভের ১০-১২ শতাংশ ধারণ করে। তাই মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো সংকট বিশ্ব অর্থনীতিকে আঘাত করবে। তেলের দাম বাড়লে মুদ্রাস্ফীতিও বাড়বে। ” তিনি আরও বলেন, “এই সংকট বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি’র পূর্বাভাস অনুযায়ী বৈশ্বিক জিডিপি অর্জনের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। হরমুজ প্রণালী ঘিরে আরও বেশি বিধিনিষেধ এলে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ”

দেশীয় প্রেক্ষাপটে ড. শহীদত বলেন, “আমাদের উৎপাদন কার্যক্রম জ্বালানিনির্ভর। জ্বালানির দাম বাড়লে উৎপাদন কমে যাবে, জিডিপি কমবে এবং বেকারত্ব বাড়বে। অন্যান্য দেশ যেখানে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে, সেখানে বাংলাদেশে তা ৯ শতাংশের ওপরে, যা অনেক বেশি। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের ক্ষতি বেশি হবে। ” যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে ডলারের বিনিময় হার আরও বাড়বে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে বলে তিনি জানান।

সরকারকে দ্রুত বিকল্প জ্বালানির উৎস খোঁজার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা চাইলে চুক্তির ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভবিষ্যৎ বাণিজ্য করতে পারি। পাশাপাশি বিকল্প উৎস থেকেও তেল আমদানির ব্যবস্থা ও রিজার্ভ গড়ার উদ্যোগ নিতে পারি। ”

এই সংঘাত এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে, যখন বিশ্ব বাণিজ্য ইতিমধ্যেই সুরক্ষাবাদী নীতির কারণে চাপের মধ্যে রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে এবং বাণিজ্য ব্যয় বাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ ও বাণিজ্য সুরক্ষাবাদ একত্রে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দিতে পারে। তেলের দাম বাড়ছে, যুদ্ধের ঝুঁকিও বাড়ছে, এ অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্ভাব্য চাপের মুখে পড়তে পারে। জ্বালানি নিরাপত্তা, রপ্তানি স্থিতিশীলতা, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ -সবকিছুই চাপে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে নীতিনির্ধারকদের সতর্ক থাকার পাশাপাশি উৎস বৈচিত্র্য ও সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি জোরদারের আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা, যাতে দেশের অর্থনৈতিক গতি রক্ষা করা যায়, বৈশ্বিক অস্থিরতার মাঝেও ।