Last Updated on 3 weeks by zajira news
অর্থনীতি ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, বিপর্যস্ত আর্থিক খাত সংস্কার ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের মতো চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছে ।
সোমবার (২ জুন) বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রস্তাবিত এ বাজেট ঘোষণা করেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। একই সঙ্গে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটও উপস্থাপন করেন তিনি। এছাড়া প্রস্তাবিত ‘অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫’ প্রকাশ করা হয়েছে।
এবারের বাজেট বক্তৃতার শিরোনাম হচ্ছে- ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’।
সর্বশেষ গত এপ্রিলে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশে নেমে আসবে বলে অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তাবিত বাজেটে নানা ধরনের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।
অন্যদিকে রাজস্ব আয়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রস্তাবিত বাজেটে করভিত্তি সম্প্রসারণ, করহার বাড়ানো, কর হার পুনর্বিন্যাস,ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি এবং সরকারি সেবা ব্যয় ও মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া বাজেটে কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও এলডিসি-উত্তর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাজেটের আকার: প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ব্যয়ের পরিমাণ বা আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপি’র ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় টাকার অংকে বাজেটের আকার কমছে ৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে রাজস্ব: প্রস্তাবিত বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থায়ন তথা রাজস্ব আদায়। বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি’র অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট প্রাপ্তি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। এছাড়া এনবিআর-বহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৯ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তির (এনটিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে বৈদেশিক অনুদানের প্রত্যাশা করা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে ঘাটতি: প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি পূরণে আগামী বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এটি ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাজেটে জিডিপি: বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অবশ্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবির পূর্বাভাস হলো- এবার প্রবৃদ্ধি এর চেয়ে অনেক কম হবে।
বাজেটের অনুন্নয়ন ব্যয়: নতুন বাজেটের আকার কমলেও পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে এ খাতের ব্যয় ধরা হতে পারে ৫ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। অনুন্নয়ন ব্যয় বাড়লেও কমবে উন্নয়ন ব্যয়।
এডিপি: প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-এর আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটে সুদ পরিশোধ: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ এক লাখ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক ঋণের সুদ ২২ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাক্তি করমুক্ত আয়সীমা: উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি, আগের মতোই সাড়ে তিন লাখ টাকা অপরিবর্তিত থাকছে। তবে ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ করবর্ষের জন্য স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। গেজেটভুক্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এ আহত ‘জুলাই যোদ্ধা’ করদাতাদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে স্বাভাবিক ব্যক্তি ও হিন্দু অবিভক্ত পরিবার করদাতাদের জন্য ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ করবর্ষে মোট আয় করমুক্ত আয়ের সীমা অতিক্রম করলে ন্যূনতম করের পরিমাণ এলাকা নির্বিশেষে পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন করদাতাদের ন্যূনতম করের পরিমাণ এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
থাকছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ: প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটেও ফ্ল্যাট কেনায় অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। একই সঙ্গে ভবনের নির্মাণের এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে আগের চেয়ে করের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এলাকাভেদে আয়তন অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই টাকার উৎস সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
বেড়েছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনীর আওতায়: বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতা বাড়ছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনীর আওতায় বিভিন্ন ভাতা ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে বাড়ছে। এরমধ্যে বয়স্ক ভাতার মাসিক হার ৬০০ টাকা হতে ৬৫০ টাকায়, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের মাসিক ভাতা ৫৫০ টাকা হতে ৬৫০ টাকায়, প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতা ৮৫০ টাকা হতে ৯০০ টাকায়, এবং মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় প্রদত্ত মাসিক ভাতার হার ৮০০ হতে ৮৫০ টাকায় বৃদ্ধি। এছাড়া, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য মাসিক ভাতার হার ৬৫০ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করছি।
বাজেটে মূল্যস্ফীতি: আগামী অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। চলতি অর্থবছরেও একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে গত এপ্রিল মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।