Last Updated on 3 weeks by zajira news
অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: রাজধানীর মহাখালীর কড়াইল বস্তির আগুনে সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব গৃহকর্মী, দিনমজুর ও রিকশাচালক। খোলা আকাশের নিচেই রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছেন তারা। আগুন নিয়ন্ত্রণের পর অঙ্গার হওয়া ধ্বংসাবশেষে জিনিসপত্র খুঁজতে দেখা যায় অনেক বস্তিবাসীকে।
মঙ্গলবার বিকেলে যখন কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগে তখন বেশিরভাগ বাসিন্দাই ছিলেন বাইরে। খবর পেয়ে ছুটে এসে দেখেন সবই শেষ হয়ে গেছে।
বুধবার (২৬ নভেম্বর) সকাল ৮টার দিকে গিয়ে দেখা গেল, মানুষের ভিড়; বেশিরভাগই উৎসুক জনতা।
নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটতেই মেয়েকে বোনের কাছে রেখে নিজের পোড়াঘরে এলেন নাজমা বেগম। পুড়ে ভেঙে পড়া টিন আর ছাইয়ের গাদার মধ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন তিনি—১৪ বছরের সংসারের কিছু পাওয়ার আশায়।
নারীদের অনেকেই আশপাশের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। একটা একটা করে টাকা জমিয়ে ঘরের আসবাবপত্র, টিভি, ফ্রিজ কিনেছিলেন তারা। নগদ জমানো টাকা, টুকটাক গয়নাও ছিল কারো ঘরে। আগুনে পরনের পোশাকটা ছাড়া সবই হারিয়েছেন বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দা।
আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে—এমন সন্দেহের কথা বলেছেন অনেক বস্তিবাসী। আর সন্দেহের উৎস হিসেবে বলেছন ফেইসবুকে দেখা ‘তথ্যকে’। নিজেরা সন্দেহজনক কিছু দেখেছেন—এমন কথা কেউ বলেননি।
বয়োজ্যেষ্ঠ আব্দুল মতিন বলছেন, “এইখানে নাকি মার্কেট করব, হেইজন্যি উচ্ছেদ করতে আগুন লাগাই দিছে। আমাগেরে ভালোভাবে কইলেই তো আমরা চইল্যা যাইতাম।”
৯০ একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা ৮০ হাজার মানুষের এ আবাসস্থলই ঢাকার সবচেয়ে বড় বস্তি। ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানী লাগোয়া কড়াইল বস্তির বাসিন্দাদের প্রায় সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। আশপাশের বাসা-বাড়ি, অফিস, দোকানে কাজ পাওয়া যায় অনেকটা সহজেই, সেই কারণে কিছুটা কষ্ট করে হলেও কড়াইলের বাসিন্দা হয়েছেন অনেকেই।
বনানী ক্লাবের এই নিরাপত্তাকর্মী বলছেন, আগুন লাগার সময় তিনি ঘরেই ছিলেন। স্ত্রীকে কোনোরকমে বের করে দিতে পারলেও নিজে আটকা পড়েন। পরে জানালা নিয়ে নামতে গিয়ে পা কেটে যায়।
ইক সংলগ্ন বস্তির ধ্বংসস্তূপে কিছুটা ঠান্ডার মধ্যে পাতলা গেঞ্জি গায়ে, খালি পায়ে থাকা অনেক শিশুকে দেখা গেল জিনিসপত্র খুঁজে বেড়াতে।
বস্তির গলিপথগুলোতে উপচেপড়া মানুষের স্রোত। বেশিরভাগই দর্শনার্থী। এ ভিড়েই হাতে পরোটা-সবজির টোপলা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছিলেন আসমা বেগম।
গত বছরই সমিতি থেকে ঋণ করে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে এখানে একটা ঘর কিনেছিলেন তিনি। এখন কিস্তি শোধের দুশ্চিন্তা আর তিলেতিলে গড়া সংসারটা পুড়ে যাওয়ার শোক মিলে ভেঙে পড়েছেন আসমা। তিনি বলছিলেন, “আমি মাইনষের বাসা-বাইত্তে কাম করি। গেল বছর সমিতিত্তে টেকা (ঋণ) তুইলা একটা ঘর কিনছি। ভাবছিলাম পোলাপাইনডি থাকবো।
“আমার ঘরডা গ্যাছে, কিচ্ছু নাই। ভাইয়ে আইসা কয়ডা টেকা দিছে হেইডা দিয়া নাস্তা কিনছি। এখন আবার কিস্তিও দেওন লাগব।”
দুই ছেলেকে নিয়ে ধ্বংসস্তুপে বসে আহাজারি করছিলেন গৃহকর্মী ঝুমা আক্তার। তিনি বলছেন, “বাসাবাড়িতে কাম কইরা একটা একটা কইরা জিনিস করছি। ফ্রিজ কিনছি, ৩১ হাজার ট্যাকা দিয়া টিভি কিনছি। সব গ্যাছে। ম“পোলাগো বাপের একটা অটোরিকশা আছিল গ্যারেজে রাখা। হেইডাও গ্যাছে।”
বস্তির ভেতরেই ভাঙারির দোকান চালাতেন আলম ও ফাতেমা আক্তার দম্পতি। তাদের বসত ঘর আর দোকান দুটোই পুড়েছে। এক বছর বয়সি ছেলেকে নিয়ে এই দম্পতি বসে ছিলেন ভস্মীভূত হওয়া দোকানটার সামনে। ফাতেমা বললেন, “দোকান পুড়ছে, ঘরডাও গেছে। বাচ্চাডার কোনো কাপড়-চোপড় নাই। ছোট বাচ্চা, বারবার প্যান্ট ভিজায়। “একবার ভিজাইলে যে ওরে পড়াবো এরকম কাপড় নাই। এইজন্যে দাম দিয়া প্যাম্পার (ডায়াপার) কিন্যা আনলাম, নাইলে বাচ্চাডার ঠান্ডা লাগব।”
মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) সন্ধ্যায় লাগা ভয়াবহ আগুনে সেখানকার প্রায় দেড় হাজার ঘর পুড়ে যাওয়ার তথ্য দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সেদিন সন্ধ্যা ৫টা ২২ মিনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস, এরপর একে একে ১৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয়।
সোয়া পাঁচ ঘণ্টা ধরে চেষ্টার পর রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণের খবর দেয় বাহিনীটি। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টায় আগুন নির্বাপণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, আগুনে কোনো হতাহত নেই। আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে।


