সময়ের জনমাধ্যম

কে হচ্ছে হিসবুল্লাহ প্রধান, ইসরায়েলকে মোকাবিলায় তারা কতটা শক্তিশালী

Last Updated on 2 months by zajira news

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: লেবাননের দক্ষিণ ও রাজধানী বৈরুতের অংশবিশেষে ইসরায়েল হামলা চালানোর পর হিজবুল্লাহও দেশটির উত্তরাঞ্চলে কয়েক শ রকেট ছুড়ে জবাব দিয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে শুরু হওয়া সংঘাত এখন লেবানন হয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।

ইরানের কাছ থেকে অনেক বছর ধরেই আর্থিক ও সামরিক—উভয় দিক থেকে জোরালো সমর্থন পেয়ে আসছে হিজবুল্লাহ। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদেরও ঘনিষ্ঠ মিত্র গোষ্ঠীটি।

হিজবুল্লাহ একটি শিয়া মুসলিম রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র গোষ্ঠী। লেবাননের পার্লামেন্ট ও সরকারে দলটির উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীকেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তারা।

হিজবুল্লাহর আবির্ভাব মূলত ১৯৮০–এর দশকে, ইসরায়েলবিরোধিতাকে কেন্দ্র করে। লেবাননে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০–এর গৃহযুদ্ধকালে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় হিজবুল্লাহ।ইরানের কাছ থেকে অনেক বছর ধরেই আর্থিক ও সামরিক—উভয় দিক থেকে জোরালো সমর্থন পেয়ে আসছে হিজবুল্লাহ। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদেরও ঘনিষ্ঠ মিত্রও গোষ্ঠীটি। হিজবুল্লাহর সশস্ত্র শাখা ইসরায়েলি বাহিনী ও লেবাননে মার্কিন বাহিনীকে লক্ষ্য করে একাধিকবার প্রাণঘাতী আক্রমণ চালিয়েছে।

লেবানন থেকে ২০০০ সালে ইসরায়েল যখন সেনা প্রত্যাহার করে, তখন হিজবুল্লাহ তাদের দেশছাড়া করার কৃতিত্ব দাবি করে। পরে সীমান্তের বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোতেও ইসরায়েলের অবস্থানের বিরোধিতা অব্যাহত রাখে সশস্ত্র সংগঠনটি।

ইসরায়েল–লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহর তৎপরতাকে ঘিরে ২০০৬ সালে পুরোদস্তুর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েল।ওই যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনারা দক্ষিণ লেবাননে ঢুকে পড়েন এবং সেখান থেকে হিজবুল্লাহর হুমকি নির্মূল করার চেষ্টা চালান। লড়াইয়ে প্রাণ হারান প্রায় এক হাজার বেসামরিক লোক। লড়াইয়ে হিজবুল্লাহ জয়ী হওয়ার দাবি করে এবং তখন থেকেই নিজেদের যোদ্ধার সংখ্যা বাড়ানো ও অস্ত্রশস্ত্র সমৃদ্ধ করা শুরু করে তারা।

পশ্চিমা দেশ, ইসরায়েল ও উপসাগরীয় আরব দেশগুলো হিজবুল্লাহকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিয়ে রেখেছে।

২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ–ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনারা দক্ষিণ লেবাননে ঢুকে পড়েন এবং সেখান থেকে হিজবুল্লাহর হুমকি নির্মূল করার চেষ্টা চালান। লড়াইয়ে প্রাণ হারান প্রায় এক হাজার বেসামরিক লোক। লড়াইয়ে হিজবুল্লাহ জয়ী হওয়ার দাবি করে এবং তখন থেকেই নিজেদের যোদ্ধার সংখ্যা বাড়ানো ও অস্ত্রশস্ত্র সমৃদ্ধ করা শুরু করে তারা।

লেবাননে ১৯৯২ সাল থেকে জাতীয় নির্বাচনে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে হিজবুল্লাহ এবং একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে তারা।

২০২২ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে হিজবুল্লাহ ও এর মিত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। তবে তখন থেকে লেবাননে কোনো নতুন সরকার গঠিত হয়নি। দেশটি চলছে তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের অধীনে।

হিজবুল্লাহকে নিয়ে লেবাননের বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে বিভক্তি। যদিও বাস্তবে হিজবুল্লাহর ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে, তবু অনেক সমালোচনাকারীর অভিযোগ, সংগঠনটি রাজনৈতিকভাবে দুর্নীতিতে যুক্ত। এর সামরিক সক্ষমতার বিরোধিতাও করে থাকেন তাঁরা। হিজবুল্লাহকে তাঁরা দেশের চলমান সংঘাতের জন্য দায়ী উল্লেখযোগ্য একটি পক্ষ হিসেবেও দেখেন। একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে হিজবুল্লাহ লেবাননজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল পরিচালনা করে।

হিজবুল্লাহর হাজার হাজার যোদ্ধা রয়েছে। আছে দক্ষিণ লেবাননে ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল সম্ভার। বিশ্বের অন্যতম সশস্ত্র বেসরকারি সামরিক সংগঠন হিসেবেও হিজবুল্লাহকে ধরা হয়। সংগঠনটিকে অর্থ ও অস্ত্রসরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করে ইরান।

হিজবুল্লাহর দাবি, তাদের যোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ। যদিও নিরপেক্ষ সূত্রের অনুমান, এটি ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার। হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা সুপ্রশিক্ষিত ও যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে লড়াই করেছেন এ বাহিনীর সদস্যরা।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, হিজবুল্লাহর ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। হিজবুল্লাহর অস্ত্রভান্ডারে থাকা এসব রকেটের বেশির ভাগ আকারে ছোট, ‘আনগাইডেড’, ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য।

তবে সশস্ত্র সংগঠনটির বিমান ও যুদ্ধজাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ইসরায়েলের একেবারে ভেতরে আঘাত হানতে সক্ষম ‘গাইডেড’ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। লেবাননে হিজবুল্লাহর রয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গাজার সশস্ত্র সংগঠন হামাসের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র।

শিয়া নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৯২ সাল থেকে হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সংগঠনটিকে একটি রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর। ইরান ও এর সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গেও হাসান নাসরুল্লাহর রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।

গত ৩০ জুলাই ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) ঘোষণা করে, বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে তাদের এক বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডার ফুয়াদ শোকর নিহত হয়েছেন।

পরদিন ফিলিস্তিনের হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়া ইরানের রাজধানী তেহরানে হামলায় নিহত হন। এ ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করা হলেও এটি স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেনি দেশটি।

এরপর গত ২৫ আগস্ট আইডিএফ দাবি করে, হিজবুল্লাহ তাদের জ্যেষ্ঠ নেতা ফুয়াদ হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে—এমনটা জানতে পেরে লেবাননের দক্ষিণে সংগঠনটির হাজারো রকেট লঞ্চার লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে তারা।

ওই ঘটনায় হিজবুল্লাহও ইসরায়েলে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। সংগঠনটি বলেছে, ইসরায়েলে শত শত রকেট ও ড্রোন হামলা চালাতে সক্ষম তারা। তবে তারা দেশটির প্রধান প্রধান শহরকে নিশানা বানায়নি এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও ব্যবহার করেনি।

দুপক্ষের সাম্প্রতিকতম উত্তেজনা বেড়ে গেছে গত ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর লেবাননে হাজারো পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের ঘটনায়। এসব বিস্ফোরণে ৩৯ জন নিহত ও কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন।ওই আক্রমণের জন্য হাসান নাসরুল্লাহ ইসরায়েলকে দায়ী করে বলেছেন, ‘ইসরায়েল সব রেডলাইন অতিক্রম করেছে।’

২০ সেপ্টেম্বর বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে ইসরায়েলের আরেকটি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষস্থানীয় দুই সেনাকমান্ডার ইব্রাহিম আকিল ও আহমেদ ওয়াহবিসহ সংগঠনটির অন্তত ১৬ সদস্য নিহত হন। হামলায় নিহত হয় কয়েকটি শিশুসহ অন্যান্য বেসামরিক লোক।

নাসরুল্লাহ কয়েক বছর ধরেই জনসমক্ষে আসেন না। ইসরায়েলের হাতে হত্যার শিকার হওয়া থেকে বাঁচতেই তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে আছেন বলে মনে করা হয়।প্রকাশ্যে না এলেও হিজবুল্লাহর কাছে নাসরুল্লাহর আবেদন যথেষ্ট রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে সম্প্রচার করা হয় তাঁর টেলিভিশন ভাষণ।

ইসরায়েলের বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার পর লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলটির নতুন প্রধান কে হচ্ছেন, তা নিয়ে জল্পনা চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, হিজবুল্লাহর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হাশেম সাফিউদ্দিন দলটির নতুন প্রধান হতে যাচ্ছেন।

সাফিউদ্দিন হিজবুল্লাহর নির্বাহী কাউন্সিলের প্রধান। গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক বিষয় দেখভাল করা তাঁর দায়িত্ব। তিনি গোষ্ঠীটির জিহাদ কাউন্সিলেরও সদস্য। নিজেদের সামরিক অভিযানের ব্যবস্থাপনা করাই এই কাউন্সিলের কাজ।

সাফিউদ্দিন প্রয়াত নাসরুল্লাহর চাচাতো ভাই। নাসরুল্লাহর মতো তিনিও ধর্মীয় পণ্ডিত। তিনিও মাথায় কালো পাগড়ি পরেন।

২০১৭ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাফিউদ্দিনকে সন্ত্রাসী তকমা দেয়। গত জুনে ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর এক কমান্ডার নিহত হওয়ার পর তিনি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। ওই কমান্ডারের দাফন অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘(শত্রুদের) কান্না ও বিলাপের জন্য প্রস্তুত হও।’ সাফিউদ্দিনের বিবৃতিতে প্রায় সময় হিজবুল্লাহর সামরিক অবস্থানের প্রতিফলন থাকে।