সময়ের জনমাধ্যম

ক্ষমার রাত শবে বরাতেও যাদের ক্ষমা করা হয় না

Last Updated on 1 year by admin

ধর্ম ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: শবে বরাত শব্দ দুটি হাদিসে নেই তবে হাদিসের ভাষায় এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা ১৫ শাবানের রাত বলা হয়। ‘শবেবরাত’ ফারসি শব্দ। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ নাজাত বা মুক্তি। এই দুই শব্দ মিলে শবে বরাত অর্থ হয় মুক্তির রজনী।

হাদিসবিশারদদের ভাষ্যমতে, হাদিসটির মান সহিহ তথা বিশুদ্ধ। এ জন্যই ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) তাঁর প্রসিদ্ধ হাদিসে রচিত কিতাব ‘কিতাবুস সহিহ’-এ হাদিসটি উল্লেখ করেছেন।

বিভিন্ন হাদিস থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়, এই রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষ পদ্ধতিতে কোনো ইবাদত করেননি এবং সাহাবায়ে কেরামকেও তা করার নির্দেশ দেননি। সুতরাং আমাদের সমাজে প্রচলিত শবেবরাতের বিশেষ পদ্ধতির যে নামাজের কথা বলা হয় তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট। এগুলো বিশ্বাস করা এবং এগুলোর ওপর আমল করা কোনোভাবেই জায়েজ নেই; বরং ফজিলতপূর্ণ এই রাতের আমলের ব্যাপারে হাদিসের যেসব নির্দেশনা-ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা সবই ব্যক্তিগত নফল ইবাদত।

বেশি বেশি নফল নামাজ ও দীর্ঘ ইবাদত প্রসঙ্গে আম্মাজান আয়েশা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে আমার ধারণা হলো তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা, তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি জবাবে বললাম, না, হে আল্লাহর রাসুল, আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন! নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভালো জানেন।

তাই আমাদের উচিত মনগড়া ইবাদত-আমল পরিহার করে যথাসম্ভব রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে বেশি বেশি নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, তাওবা-ইস্তিগফার ও জিকির-আজকারে মশগুল থাকা।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের ১৪ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থায়।’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৩৫৫৪)

এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে নফল নামাজে দীর্ঘ কিরাত পড়া এবং লম্বা সিজদা করা এ রাতের বিশেষ একটি আমল।

এই রাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করা। কারণ বরকতময় এই রাতে আল্লাহ তাআলা প্রথম আকাশে নেমে বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন। তাদের গুনাহ মাফ করেন। এই মর্মে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন অর্ধ শাবানের রাত আগমন করে তখন আল্লাহ তাআলা প্রথম আকাশে অবস্থান করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া অন্যদের ক্ষমা করে দেন। (মুসনাদে বাজজার, হাদিস : ৮০)

তাই সংকটময় পরিস্থিতিতে এই রাতে আমাদের আল্লাহর দিকে মনোযোগী হওয়া, আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং করোনাভাইরাস থেকে হেফাজতের দোয়া করা উচিত।

নফল নামাজ, দোয়া ও ইস্তিগফারের পাশাপাশি এই রাতে আমরা কোরআন তিলাওয়াতের আমলটি গুরুত্বের সঙ্গে করতে পারি। সাহাবি আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার পরিবারবর্গ আছে। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, তারা কারা? জবাবে তিনি বলেন, যারা কোরআন বেশি বেশি তিলাওয়াত করে তারা হচ্ছে পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার পরিবারবর্গ। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫)

পরের দিন রোজা রাখা : এ প্রসঙ্গে আলী (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ১৫ শাবানের রাত (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখো। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৮)

এই বর্ণনাটির সনদ দুর্বল হলেও তা গ্রহণযোগ্য। হাদিস বিশারদদের মতে, ফজিলতপূর্ণ বিষয়ে জয়িফ হাদিস আমলযোগ্য। তা ছাড়া শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখার কথা সহিহ হাদিসে এসেছে এবং আইয়ামে বীজ অর্থাৎ প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখার বিষয়টিও সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে কোরআন মাজিদে সরাসরি নির্দেশনা না থাকলেও হাদিস শরিফে নির্ভরযোগ্য সনদ বা বর্ণনাসূত্রে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

বিখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তাঁর সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৫৬৬৫)

তাহলে দেখা যাচ্ছে নিম্নক্ত শ্রেনীর মানুষগুলো
শবে বরাতেও ক্ষমা না পেয়ে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। তারা হলো-
১. জাদুকর;
২. শরাব খোর তথা মদ্যপানকারী বা নেশাকারী;
৩. জিনাকারী তথা ব্যভিচারী ব্যক্তি;
৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী;
৫. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান;
৬. গীবত বা পরনিন্দাকারী;
৭. (দান ও কল্যাণের) কৃপণ এবং ওই হিংসুক ব্যক্তি যে তিন দিনের বেশি অপর মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রাখে। এদের কখনো মাফ করা হয় না।

তাই আসুন, বিশুদ্ধ আমলের মাধ্যমে এ রাতের ফজিলত, বরকত ও মাগফিরাত অর্জনে সচেষ্ট হই। সব ধরনের বিদআত বর্জন করি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের এ রাতে সব ধরনের কল্যাণ দান করুন। আমিন।