Last Updated on 1 year by zajira news
লেখক নিশাত সুলতানা : এ বছর ফেব্রুয়ারিতে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক তার পথচলার ২০ বছর পূর্ণ করেছে। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি আত্মপ্রকাশ করেছিল, সময়ের পরিক্রমায় তা আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পায়। শুরু থেকেই ফেসবুকের বিষয়বস্তু, প্রয়োজনীয়তা, পরিধি, কার্যকারণ ইত্যাদি নিয়ে ছিল নানা বিতর্ক। তবে সেই সব তর্ক-বিতর্কে থেমে থাকেনি ফেসবুকের ব্যাপ্তি ও সামনে এগিয়ে চলা।
জনপ্রিয় হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু জনপ্রিয়তা লাভের এই চেষ্টা ভয়ংকর হয়ে ওঠে তখন, যখন যে কেউ যেকোনো কৌশলে স্বল্প সময়ে জনপ্রিয় হতে গিয়ে নিজের সীমারেখাকে অতিক্রম করে। ফেসবুক যেন এখন স্বল্প সময়ে তারকা হওয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম। এই দৌড়ে শামিল হয়েছে অনেকেই।
দুই দশক ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে মাধ্যমটি রাজত্ব করেছে; আজও করছে। ফেসবুকের বদৌলতে বাস্তব পৃথিবীর গণ্ডি ছাপিয়ে ভার্চ্যুয়াল জগতে সম্পর্ক রক্ষার অভিনব কৌশল সম্পর্কে জানতে পেরেছে মানুষ; যা কিশোর থেকে শুরু করে প্রবীণ প্রজন্মকে আন্দোলিত করেছে। সম্পর্ক ও তার বিস্তৃতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে ফেসবুক, দিয়েছে অন্য উচ্চতা। পরবর্তী সময়ে ইনস্টাগ্রাম, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও জনপ্রিয়তা পায়।
ফেসবুক নামক মাধ্যমটি থেকে অনেক প্রাপ্তির আড়ালে আমরা হারিয়েছি অনেক কিছুই। ফেসবুক যেমন অনেক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্ব ও পুরোনো সম্পর্ককে ফিরিয়ে দিয়েছে; ঠিক তেমনি আমাদের জীবন থেকে অনেক ক্ষেত্রে কেড়ে নিয়েছে সম্পর্কের আবেগীয় ভিত্তিটুকু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেই সত্যকথন ও সম্পর্কের মজবুত সেতুবন্ধ। সম্পর্কগুলো যেন নিতান্তই সম্পর্কের জন্য সম্পর্ক।
ফেসবুকে ডুবে থেকে সংবাদপত্র পড়ার কিংবা সংবাদভিত্তিক বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারার প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত অনুভব করে না অনেকে। এভাবেই আমরা দিন দিন যেন সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠছি ফেসবুকের ওপর। ফেসবুক যেন আমাদের চিন্তাচেতনা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এই নির্ভরশীলতাকে পুঁজে করেই বর্তমানে সূচিত হয়েছে ফেসবুকভিত্তিক বাণিজ্যের নতুন ধারা। এতে লাভ দুই পক্ষেরই। এমনকি এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে ইউটিউবে জনপ্রিয় হয়েছে কিংবা হচ্ছে অনেকেই।
মেটা-দুনিয়ায় সম্পর্কগুলো যেন মেকি ও লোকদেখানো। তবে ‘সম্পর্কের নেটওয়ার্ক’ পরিচয়কে গৌণ করে আজকাল এই মাধ্যমে মুখ্য হয়ে উঠেছে ফেসবুকভিত্তিক নানা বিনোদন। অনেকের কাছেই এখন ফেসবুক সবচেয়ে বড় বিনোদনের মাধ্যম। কারও কাছে তা আবার সংবাদমাধ্যমও বটে।
অন্যান্য মাধ্যমের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে হলে চাই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য করে করে তোলা, কনটেন্টের গুণগত মান বজায় রাখা ও সবার গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করা। চটুল কনটেন্ট সাময়িকভাবে জনপ্রিয় হলেও একসময় তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে মানুষ। তাই আচরণগত পরিবর্তন আর মন্দ কিছুকে সামাজিক প্রত্যাখ্যান করাই হতে পারে এই গুরুতর সমস্যার একমাত্র সমাধান।
জনপ্রিয়তা এখানে সংজ্ঞায়িত হয় লাইক, কমেন্ট, ভিউ আর সাবস্ক্রিপশন দিয়ে। এখানে কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর গুণগত মান বিবেচিত হচ্ছে না। হালে ‘রিল’ নামক অপশনটি সস্তা জনপ্রিয়তার কফিনে যেন শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে। এখানে যার যা খুশি, তা-ই করছে।
সেই প্রবণতা ফেসবুক ওয়ালে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে, নাকি দুর্গন্ধ; তা নিয়ে আজকাল কেউ ভাবে না। যে যার মতো করে এখানে ফায়দা হাসিল করছে; কেউবা খ্যাতি, কেউবা বাণিজ্য, আবার কেউবা দুটোই। যে যা করছে আমরা তা দেখছি, শুনছি, ছড়িয়ে দিচ্ছি। আমরা অধিকাংশই নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাদের সহযোগিতা করছি।
আজকাল মনে হয়, এইভাবে মন্দের সঙ্গে আপস করতে করতে হয়তো আমাদের রুচির মৃত্যু ঘটছে এবং নোংরা ও অশ্লীলে আমরা অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমাদের অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা আজকাল কদাকারভাবে বেরিয়ে আসছে কনটেন্টের কমেন্ট সেকশনে। কী নোংরা ও কদর্য আমাদের চিন্তা ও ভাষার প্রয়োগ!
আমাদের রুচির অপমৃত্যু ঘটায় ফেসবুক সেলিব্রিটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে অনেক অর্বাচীণ; যাদের কেউবা গালিবিদ্যায় পারদর্শী, কেউবা পণ্যের প্রমোশনাল করতে গিয়ে শিষ্টাচার ও সভ্যতার সীমারেখা লঙ্ঘন করছে, কেউবা কুরুচিপূর্ণভাবে ফুড ভ্লগিং করছে; কেউবা আবার ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা না জেনেই নানা জ্ঞান বিতরণ করছে। এই যুদ্ধে থেমে নেই শিশুরাও।
তারাও লেগে পড়েছে তারকা হওয়ার যুদ্ধে। কথা বলার মতো জ্ঞান, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করার আগেই তারা খুদে তারকা কিংবা মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে হাস্যকরভাবে নিজেদের উপস্থাপন করছে। ফেসবুক প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করে যেনতেনভাবে কনটেন্টের ভিউ বাড়িয়ে সহজ বাণিজ্যে নেমে পড়েছে অনেকেই।
আমাদের নীরবতা, বোকামি ও নির্লিপ্ততাকে কাজে লাগিয়ে এরা খ্যাতির চূড়ায় উঠছে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি। তারকা হতে আজকাল আর সাধনা, জ্ঞান আর নিষ্ঠার প্রয়োজন হয় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অস্বস্তি আর সীমারেখাকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেই যেন তারকা হওয়ার পথ পরিষ্কার হয়।
যেকোনো উপায়ে তারকা হতে গিয়ে কিংবা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে কেউবা ইচ্ছে করে বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে, নাটক করছে, একে অন্যের নামে কাদা ছিটাচ্ছে এবং রাতারাতি তারকা হয়ে উঠছে।
কোনো আইনকানুন দিয়ে এই প্রবণতা বন্ধ করা যাবে বলে মনে হয় না; আর সবকিছুর সমাধান আইন দিয়ে হয়ও না। এতে ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হয়, অনেক সৃজনশীলতা আর শুভচিন্তার মৃত্যু ঘটে। কারণ আমরা দেখেছি, অনেক ভালো উদ্যোগের জন্ম হয়েছে এই মাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহারের মাধ্যমে। অনেক মানুষ উপকৃত হয়েছে, আশাজাগানিয়া সুপ্ত প্রতিভারা স্বীকৃত হয়েছে।
এই মুহূর্তে তাই সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো, মানুষের আচরণগত পরিবর্তন। মন্দ কিছুতে নীরব থাকার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। মন্দকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং মজার ছলে হলেও মন্দকে ছড়ানোর সহযোগী হওয়া যাবে না। অন্যদিকে যারা মন্দ ও অশ্লীলতাকে ছড়িয়ে জনপ্রিয় হতে চায়, তাদেরও নিজেদের পরিণতি সম্পর্কে ভাবতে হবে। যে জনপ্রিয়তার ভিত্তি ঠুনকো, তা একসময় খসে পড়বেই।
অন্যান্য মাধ্যমের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে হলে চাই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য করে করে তোলা, কনটেন্টের গুণগত মান বজায় রাখা ও সবার গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করা। চটুল কনটেন্ট সাময়িকভাবে জনপ্রিয় হলেও একসময় তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে মানুষ। তাই আচরণগত পরিবর্তন আর মন্দ কিছুকে সামাজিক প্রত্যাখ্যান করাই হতে পারে এই গুরুতর সমস্যার একমাত্র সমাধান।
শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যা কিছু ভালো, তা-ই টিকে থাকে। আর মন্দ যা কিছু, তা হয় কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়; নয়তো মন্দ হিসেবেই বেঁচে থাকে মানুষের চোখে করুণার পাত্র হয়ে। তাই মন্দ কিছুর কর্ণধার হওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। স্বল্প সময়ে দ্রুত জনপ্রিয়তার ফলাফল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থায়ী হয় না। ক্ষণিকের জনপ্রিয়তা কর্পূরের মতো উড়ে গিয়ে যা পড়ে থাকে তা হলো শূন্যতা ও হতাশা।
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
purba_du@yahoo.com