সময়ের জনমাধ্যম

চামচাতন্ত্র থেকেই হয় চোরতন্ত্র

দেশকে চামচাতন্ত্র থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত করা হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে

Last Updated on 9 months by zajira news

অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: দেশকে চামচাতন্ত্র থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত করা হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে। আইন সভা, নির্বাহী বিভাগসহ সবাই গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে চুরির অংশ হয়েছে। রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং উর্দি পরা কিংবা উর্দি ছাড়া আমলারা এর সহযোগী ছিলেন।

এই চোরতন্ত্রে শীর্ষ দুর্নীতিবাজ ছিলেন আমলারা। আর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংকিং খাতে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশ পাচার হয়ে গেছে। প্রতি বছর গড়ে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তার পরিমাণ জিডিপির প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ। বিদেশে পাচারের পরিমাণ প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হয়ে থাকতে পারে। তবে দুর্নীতি ও ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের কিছু অর্থ দেশেও রয়ে গেছে।

সেমাবার (০২ ডিসেম্বর) সরকারের শ্বেতপত্রের খসড়ার ওপর ব্রিফিংকালে এসব পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলনকক্ষে ব্রিফিং করেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। কমিটি গঠনের তিন মাসের মাথায় গত রবিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তুলে দেন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তার পরদিন গতকাল এই ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়।

এ সময় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ড. মুস্তাফিজুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম তামিম, সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের ডিরেক্টর প্রফেসর এ কে এনামুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ, রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী, বিল্ড-এর সিইও ফেরদৌস আরা বেগম, বিআইজিডির (ব্র্যাক) নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন, বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক ড. কাজী ইকবাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শারমিন্দ নীলোর্মি উপস্থিত ছিলেন।

ব্রিফিংয়ে শ্বেতপত্রের তথ্য ও গণশুনানির রায় তুলে ধরে ব্যাংকিং খাতের পর দ্বিতীয় শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে অবকাঠামো প্রকল্প, তৃতীয় জ্বালানি এবং চতুর্থ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির (আইসিটি) নাম উল্লেখ করা হয়। আর আমলাদের পর দ্বিতীয় শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে রাজনীতিবিদ এবং তৃতীয় শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করা হয়।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আমলাদের শীর্ষ দুর্নীতিবাজ বলে মনে করে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘আমাদের ধারণা ছিল রাজনীতিবিদরাই শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত; তবে গণশুনানিতে যে মতামত এসেছে, সে অনুযায়ী আমলাদের বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে উঠে এসেছে। এটি আমাদের মতামত নয়, গণশুনানির মতামত। তিনি বলেন, এটা (শ্বেতপত্র) কোনো গজদন্ত মিনারে বসে কেউ লিখেনি। জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এটি প্রণীত হয়েছে।

ড. দেবপ্রিয় জানান, পাচার ও লুটপাটের মধ্য দিয়ে যে চোরতন্ত্র কায়েম হয়েছিল, এর উৎসকাল ছিল ২০১৮-এর নির্বাচন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তিনটি সংসদ নির্বাচনের (২০১৪ সালসহ) কারচুপি চামচাতন্ত্র থেকে হয় চোরতন্ত্রএই তন্ত্র কায়েমে ভূমিকা রেখেছে। পরবর্তী সময়ে যে ভোট হয়েছে, সেখানে স্বচ্ছতার জায়গা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকারের জবাবদিহিও নষ্ট করা হয়েছে। সামাজিক শক্তিকে (নাগরিক সমাজ) দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। চোরতন্ত্র কায়েমে বিদেশি শক্তিও যুক্ত ছিল এমনটি উল্লেখ করে দেবপ্রিয় বলেন, বিভিন্ন কারণে অনেক দেশ অপ্রয়োজনীয় প্রশংসা করেছে।

তিনি বলেন, আগামী ছয় মাস বিশেষ করে পরবর্তী নির্বাচনের আগপর্যন্ত সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় পর্যন্ত কী ধরনের অর্থনৈতিক সংস্কার হবে, সে বিষয়ে সরকারের একটি কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা উচিত।

নির্বাচন অনুষ্ঠানে আগে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের সুপারিশ জানিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, দুই বছরের জন্য এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। তিনি বলেন, গত পাঁচ মাসে যেসব অর্থনৈতিক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে, সরকার তা স্পষ্ট করেনি। এটি তুলে ধরা উচিত ছিল। একই সঙ্গে আগামী ছয় মাস সরকার কী ধরনের উদ্যোগ নেবে সে বিষয়েও পরিকল্পনা তুলে ধরা দরকার।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে গেছে এমন মন্তব্য করে দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনীতির স্বার্থে মূল্যস্ফীতির হার, ব্যাংকঋণের হার কী হবে, এটি স্পষ্ট করতে হবে। শুধু চেষ্টা করলে হবে না। বিনিয়োগকারীরা যদি না বুঝে আগামী দিনে কী হবে, তার সীমারেখা কী- তাহলে আগামী দিনে সমস্যা হবে।

দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি একটি উন্নয়ন ফোরাম আয়োজনেরও সুপারিশ জানান দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, এই ফোরামে উন্নয়ন সহযোগী, রপ্তানি সুবিধা দেয় যেসব দেশ, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং যেসব দেশ বাংলাদেশ থেকে মানবসম্পদ নেয়- এই চারটি গ্রুপকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের কাছে সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরা উচিত।

এক প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় বলেন, উন্নয়নের বয়ানে খলনায়ক ছিল তথ্য-উপাত্ত। জিডিপি, রপ্তানি, মূল্যস্ফীতি বিভিন্ন সূচকের ত্রুটিপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে এই বয়ান কায়েম করা হয়েছিল। এ কারণে মধ্যম আয়ের যে ফাঁদ বলা হচ্ছে, সেই ফাঁদে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, দুর্নীতি ও লুটপাটের পাশাপাশি দেশে চরম অসমতা বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে এখন দেশের ১০ শতাংশ মানুষ ৮৫ শতাংশ সম্পদ ভোগ করছে বলেও মন্তব্য করেছেন শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান দেবপ্রিয়।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গুরুতর অবস্থায় রয়েছে এমনটি উল্লেখ করে ব্রিফিংয়ে বলা হয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। দেবপ্রিয় বলেন, দেশের ভিতর যদি স্থিতিশীলতা না থাকে, জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকে তবে সরকারের জন্য বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠবে।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মধ্যম আয়ের যে বয়ান শোনানো হয়েছিল, তার পুরোটাই ছিল ফাঁকি। আমরা সেই ফাঁকিতে পড়ে গেছি। এটা থেকে বের হওয়ার তিনটি পথ আছে। এজন্য সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, নীতির সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’

ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে অনেক অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। তবে এসব প্রকল্পে যে দুর্নীতি হয়েছে তার একটি অংশ দেশেও রয়ে গেছে। তিনি বলেন, এসব মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে যে চাপ তৈরি হবে, সেই চাপ সহনীয় করতে ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত।

ড. সেলিম রায়হান বলেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকারের মনোযোগ দিতে হবে। বিনিয়োগ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে যেসব খাতে সংস্কার দরকার সেখানে শক্তিশালী উদ্যোগ নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশে তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে যে উন্নয়ন আখ্যান করা হয়েছে, তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ।

তথ্য-উপাত্তের বিভ্রান্তি আর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাওয়ার পরও এলডিসি উত্তরণের পথে সরকারের থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এলডিসি উত্তরণে যে তিনটি নিয়ামক মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিনটি মাধ্যমেই বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। ত্রুটিপূর্ণ তথ্যের পরও এই তিনটি মাধ্যমে এগিয়ে থাকা কতটা বাস্তবসম্মত- এমন প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় জানান, তথ্যের ত্রুটির বিষয়টি আমরা বলছি, সরকার এখনো স্বীকার করেনি। সরকারের যে তথ্য জাতিসংঘে দেওয়া হয়েছে সেই তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণে ঠিকপথে আছে। জাতিসংঘ এখনো মনে করছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে কোনো বাধা নেই। যদি ভয়াবহ কোনো দুর্যোগ ঘটে তখন সংশোধনের সুযোগ থাকবে।

সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় কমিটির সদস্য প্রফেসর এ কে এনামুল হক বলেন, বিগত সরকারের আমলে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যয় তছরুপ বা লুটপাট করা হয়েছে। অধ্যাপক ম তামিম জানান, দুর্নীতির উদ্দেশ্যেই নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার না করে বিদেশি বিদ্যুৎ কোম্পানির সঙ্গে চুৃক্তি করা হয়েছে। ড. আবু ইউসুফ বলেন, রাজস্ব বোর্ড যে দাবি করে এক কোটির ওপর টিন সার্টিফিকেট, তা কার্যকর নয়। রাজধানীর হোল্ডিং নাম্বারগুলোকে টিন নাম্বারে যুক্ত করার সুপারিশ জানান তিনি।

ড. ইমরান মতিন জানান, বিগত সরকারের আমলে দারিদ্র্য বিমোচনের যে হার দেখানো হয়েছে, তা এত ঝুঁকিপূর্ণ যে সপ্তাহে দুই দিন কাজ করতে না পারলে আবার দারিদ্র্যের হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী বলেন, শ্রম রপ্তানিতে অত্যধিক টাকা নেয় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। এর কারণ এই এজেন্সিগুলো বিভিন্ন দেশের ভিসা কিনতে প্রায় ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বাংলাদেশি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছে। এই টাকা অভিবাসন ব্যয় থেকে মানুষের কাছ থেকে তুলে নিচ্ছে। ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, বিডায় ৪ থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিয়োগও নিবন্ধন হয়েছে বিগত সরকারের আমলে। এত ছোট বিনিয়োগের নিবন্ধন করার কারণ খতিয়ে দেখা দরকার। শারমীন্দ নীলোর্মী জলবায়ু তহবিল তছরুপের বিষয়টি উল্লেখ করেন।