Last Updated on 4 days by zajira news
অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: রাষ্ট্র সংস্কারের ১৯টি মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর খবর এলেও জুলাই সনদে শেষমেশ সংশয় তৈরি হয়েছে কতগুলো রাজনৈতিক দল সই করবে ?
দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চালিয়ে আসার পর জামায়াত ও এনসিপি বলছে, জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি না দিলে তাতে তারা সই করবে কিনা, সেটা ভেবে দেখবে।
আবার শেষ দিনের বৈঠকে সিপিবি ও বাসদসহ চার বামপন্থি দল জাতীয় চার নীতি বাদ দেওয়াকে কেন্দ্র করে বৈঠক বর্জন করে বলেছে, কমিশনে প্রস্তাবে পরিবর্তন না এলে জুলাই সনদে তাদের সই করার সম্ভাবনা নেই।
আর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জাতীয় সনদের এখনই আইনি ভিত্তি প্রয়োজন নেই।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২৩তম দিনের আলোচনার শুরু হয়। শুরুতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
আলোচনার এক পর্যায়ে গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুখ হাসান সনদের ভূমিকায় ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের বিষয়টি যুক্ত করার দাবি তোলেন। পরে অন্যরা কথা বলতে চাইলে সুযোগ দেওয়া হয়নি। তবে সংলাপের বিরতিতে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন।
সংলাপের শুরুতে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো এবং যেসব বিষয়ে ভিন্নমত থাকবে, সেগুলোর তালিকা আপনাদের জানানো হবে। সেই ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ দলিল তৈরি করা হবে এবং সব দলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে তাকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে। চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে আপনাদের জানাব এবং আশা করি সবাই তাতে সই করবেন।”
আলোচনা শেষে আলী রীয়াজ বলেন, দীর্ঘ আলোচনা, মতপার্থক্য ও আলোচনা শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মোট ১৯টি মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে চারটি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আছে, যা পরে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হবে।
“পাশাপাশি একটা প্রশ্ন উঠেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ কী হবে? সেগুলো নিয়েও বিভিন্নভাবে আলোচনা হবে। সেই আলোচনা অব্যাহত রাখার জন্য দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যমত কমিশনকে অনুরোধ করা হয়েছে।”
কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা মনে করি যে যেকোনো প্রক্রিয়ায় এগুলো বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পথ-পদ্ধতি চিহ্নিত করতে হবে। সেই প্রচেষ্টায় রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ আছে, আন্তরিকতা আছে। আমরা অনুরোধ করেছি, তারা নিজেদের মধ্যেও আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখুক।” তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন ‘অনুঘটকের’ দায়িত্বও পালন করবে। বিস্তারিত জানাতে করা হবে সংবাদ সম্মেলন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি তুলেছে। এ স্বীকৃতি ছাড়া জুলাই সনদে সই না করার হুশিয়ারি দিয়ে রেখেছে তারা। এমনকি সরকার ও কমিশনের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকিও এসেছে জামায়াতের পক্ষ থেকে।
কিন্তু বিএনপি এখনই এতে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া কিংবা এখন থেকেই এর বাস্তবায়নের বিরোধিতা করছে। তারা সংসদের মাধ্যমে এ সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে। এদিন সংলাপের বিরতিতে জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “শুধু কমিশন নয়, এই সনদে সব রাজনৈতিক দল সই করবে। এটি একটি জাতীয় ঐকমত্য।
“এটি জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়। এটি আইনের চেয়েও বড়। জনগণের এ প্রত্যাশা (সংসদের মাধ্যমে) সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করার অঙ্গীকার আমরা করেছি।”
রাতে বৈঠক থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, “জুলাই সনদে যদি আইনি ভিত্তি দেওয়া না হয় এবং এখন থেকে এটা বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে আমরা যত জায়গায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, সেগুলোর কোনো প্রতিফলন ঘটবে না। এটাই আজকে আমাদের মূল ইস্যু।
“আমরা বলছি যে, এটার কতগুলো অল্টারনেটিভ আইনগত ভিত্তি দেওয়ার জন্য এখানে আছে। এর ভিতরে আমি রিপিট করি আবার বলেছিলাম আপনাদের কাছে যে লিগেল ফ্রেমওয়ার্ক যেটা ভালো লাগে।
“আমাদের মূল কথা হচ্ছে, এটাকে লিগালাইজ করতে হবে; আইনি মর্যাদা দিতে হবে এবং সেই মর্যাদার ভিত্তিতে এখন থেকেই ঐক্যমতের বিষয়গুলো মাঠে কার্যকর থাকবে।”
তিনি বলেন, “গভর্মেন্ট এখানে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য আন্তরিকতার পরিচয় দেবে এবং সে হিসেবেই তারা উদ্যোগ নেবে। আর আইনি ভিত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কোনো গড়িমসি হয়, তাহলে বোঝা যাবে, এর ভেতরে ‘কুচ কালা হ্যায়’।”
জামায়াতের এ নেতা বলেন, “সংস্কারকে বিলম্বিত করা, সংস্কারকে আইনি ভিত্তি না দিয়ে পাশ কেটে চলে যাওয়ার যে প্রবণতা, এটা আমাদের সুষ্ঠ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এক ধরনের ষড়যন্ত্র কিনা, সে ব্যাপারেও আজ আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
“আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, যারা যত দেরি করবে সংস্কারকে এখানে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য, তারাই মূলত নির্বাচনকে অনিশ্চিত করার জন্য দায়ী থাকবে।”
তাহের বলেন, “সংস্কারকে লিগালাইজ করার জন্য সরকার আইনগতভাবে যেটা করা দরকার সেটা করে ৫ (অগাস্ট) তারিখে এটা ডিক্লারেশন দেবে। তাহলে দেখা যাবে, দেশ নির্বাচনমুখী হয়ে যাবে। যারা পানি ঘোলা করতে চায় তারা সে সুখ পাবে না।”
সংলাপের বিরতিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট। এটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আবারও বসতে হবে। (সংসদ নির্বাচনের) দুই বছরের মধ্যে হলে আমরা প্রত্যাখ্যান করব। দ্রুত এটি কার্যকর করতে হবে।
তিনি বলেন, “আইনি ভিত্তি না দিলে, এই সনদ একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেই থাকবে। এমনটি হলে আমরা সই করব না। কারণ পরবর্তী সরকার এর স্বীকৃতি দেবে, এমন কথা ফাঁকিবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।”
রাতে বৈঠক থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, “আমরা দীর্ঘ সময় ধরে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নিয়েছি। বেশ কিছু বিষয়ে সর্বসম্মত ঐক্যমত হয়েছে, আবার কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রেখেই কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কমিশনের পক্ষ থেকে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো বিস্তারিত আলোচনা হয়নি।”
তিনি বলেন, “কমিশন যে জুলাই সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে দিয়েছে, সেটি প্রাথমিক খসড়া হলেও তাতে উল্লেখ আছে, নতুন সংসদ গঠনের পর দুই বছরের মধ্যে সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
“আমাদের আশঙ্কা হলো, যদি এসব সংস্কার এখন থেকেই বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেওয়া হয় এবং ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকারের ওপর তা ন্যস্ত করা হয়, তাহলে নানা ধরনের অনিশ্চয়তা ও সংকট তৈরি হতে পারে।”
সংবিধানের বিদ্যমান চার মূলনীতি বাদ দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এদিন বৈঠক ‘বর্জন’ করে বাম ধারার চারটি দল। রাত সোয়া ৯টার দিকে বৈঠক থেকে বেরিয়ে দলগুলোর নেতারা বলেন, জাতীয় সনদে তারা সই করবেন কিনা, তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় রাজনীতির ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসে ঐকমত্য কমিশন। রাতে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহীন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ ও বাসদ মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা।
চার মূল নীতিতে পরিবর্তন আনার বিরোধিতা করে বজলুর রশীদ বলেন, “আমরা এই সভা বর্জন করেছি। এইটা যদি বহাল রাখে, এই যে জুলাই সনদ, সেই সনদে আমরা স্বাক্ষর করতে পারবো কিনা, সেটা আমাদের থেকে ভেবে দেখতে হবে। “আমরা দলীয় ফোরামে সেটা আলোচনা করব; অসম্ভব হয়ে গেছে। এইটা রাখার পরে আমরা সনদে সই করতে পারব না।”