সময়ের জনমাধ্যম

জ্বর, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া আতঙ্ক এখন ঘরে ঘরে

তিন দিনের বেশি জ্বর থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, জ্বরকে অবহেলা করলে ভয়ের কারণ হতে পারে

Last Updated on 7 days by zajira news

নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: বর্ষা মৌসুমে ছড়িয়ে পড়েছে জ্বর ঘরে ঘরে। দিনে কখনো ঝুম বৃষ্টি, কখনো তীব্র গরম আর রোদের তাপ—এই আবহাওয়াতে জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে ছোট শিশু থেকে বয়স্ক ব্যক্তিরা। জ্বর কোনো রোগের প্রাথমিক লক্ষণ। ফলে এ সময় জ্বর হলে অবহেলা না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

কারণ এই সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগ। জ্বর নিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ।

ইমেরিটাস অধ্যাপক বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ গনমাধ্যমকে বলেন. আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে তো জ্বর হয়েই থাকে। এছাড়া গরম ঠাণ্ডা, বৃষ্টির কারণে জ্বর হচ্ছে কিছু। তবে ভাইরাস জ্বরটা বেশি হচ্ছে। সাধারণত সর্দি, কাশি, ঠাণ্ডা লাগা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েড, প্যারা টাইফয়েড, শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন, বিশেষ করে যারা বয়স্ক, ক্রনিক ডিজিজে ভোগেন, বাচ্চা এবং যারা আগে থেকে শ্বাসজনিত রোগে ভুগছেন বা সিওপিডি রোগে ভুগছেন তাদের সমস্যাটা বেশি। ছোট বাচ্চাদের ভাইরাস জ্বরটা বেশি হচ্ছে। আর ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া তো আছেই। সঙ্গে দুই-একটা জিকার কথাও শোনা যাচ্ছে বলেও যোগ করেন তিনি। এছাড়া ডায়রিয়াজনিত কারণেও জ্বর হচ্ছে, নিউমোনিয়া ইনফেকশন, টনসিলাইটিস ইনফেকশন মেনিঞ্জাইটিস, সাইনোসাইটিস—এসব কারণেও জ্বরটা হয়। যেহেতু ডেঙ্গুর সিজন চলছে, ডেঙ্গু সারা দেশে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত হচ্ছে অনেক এবং মারাও গেছে, সে কারণে তিন দিনের বেশি সময় জ্বর থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করতে হবে। যারা আগে থেকে ডায়াবেটিস, লিভারের রোগী, স্ট্রোকের রোগী, গর্ভবতী নারী আছেন, তাদের ঝুঁকি বেশি। তাদের জ্বর হলে তারা যেন অবহেলা না করেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন মূলত ৫ থেকে ৭ ধরনের জ্বর দেখা দিচ্ছে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, শ্বাসতন্ত্রীয় সংক্রমণজনিত জ্বর, পানিবাহিত সংক্রমণজনিত জ্বর, কোথাও কোথাও জিকা ভাইরাস সংক্রমণজনিত জ্বরও দেখা যাচ্ছে। এই সবগুলো রোগের সংক্রমণে—জ্বর ও মাথাব্যথা হয়। তবে ডেঙ্গুতে জ্বর, মাথাব্যথার সঙ্গে চোখের যে অক্ষিগোলক আছে তাতে তীব্র ব্যথা হয় এবং হাড়ে বা অস্থি-সন্ধিতে ব্যথা থাকে। চিকুনগুনিয়াতে জ্বর ১০৪-১০৫ ডিগ্রি উঠে যায়, অস্থি-সন্ধিতে তীব্র ব্যথা থাকে, রোগী হাঁটতেও পারে না। অন্যদিকে করোনাতে মাথাব্যথা থাকে, শরীর ব্যথা থাকে, গলায় ব্যথা থাকে বা গলা খুসখুস করে, কিন্তু সেটা ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার মতো তীব্র ব্যথা না। আর ইনফ্লুয়েঞ্জাতে শরীর ম্যাজম্যাজ করে, কিছুটা মাথাব্যথা থাকে, সেটা ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার চেয়ে কম। এছাড়া ডেঙ্গু ও চিকুনগুরিয়ার জ্বরে কিছুটা মিল রয়েছে, যেমন জ্বরের তীব্রতা, দেখার ধরন এবং ভিন্নতা দিয়ে পার্থক্যটা করা যায়। করোনাতে ব্যথা থাকে না, ইনফ্লুয়েঞ্জাতে ব্যথা থাকে। এর সঙ্গে আরও কিছু লক্ষণ থাকে। যেমন করোনাতে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাটা বেশি হয় অথবা পেট ফুলে যায়। ডেঙ্গুতে হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অথবা রোগীর শরীরে পানি কম হওয়ার কারণে তাদের শ্বাসের সমস্যা হয় এবং দাঁতের গোড়া বা নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। চিকুনগুনিয়াতে জয়েন্টে ব্যথা বেশি হয়, ডেঙ্গুতে শ্বাসতন্ত্রে পানি জমে শ্বাসের সমস্যা হতে পারে। রক্তক্ষরণ ডেঙ্গুতে বেশি হয়, চিকুনগুনিয়াতে যেটা একেবারেই হয় না। এ ধরনের লক্ষণের অনেক মিল-অমিল থাকে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন গনমাধ্যমকে বলেন, ‘এই সময়ে নানা কারণে জ্বর হচ্ছে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, আর কোভিড অবশ্য কমে গেছে। অন্যরোগে যারা ভুগছেন, যারা বয়স্ক মানুষ, দুর্বল মানুষ, বাচ্চা-শিশু, গর্ভবতী নারী তাদের জন্যে জ্বর চিন্তার কারণ। তাদের জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী গনমাধ্যমকে বলেন, ‘এই সময়ে যাদের জ্বর হয় তারা যেনো চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। চিকিৎসক রোগীর উপসর্গ শুনে এবং দুই একটা পরীক্ষার মাধ্যমে পরামর্শ দিবেন। এই জ্বরগুলোতে ভয়ের কোনো কারণ নেই, তবে অবহেলা করলে ভয়ের কারণ হতে পারে।’

সম্প্রতি বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত ‘কনটিনিউয়িং মেডিক্যাল এডুকেশন (সিএমই)’ সেশনে দেশের ভাইরাসজনিত জ্বরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান তার উপস্থাপনায় জানান, এখন জ্বর হলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।

আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে বাড়ছে ভাইরাসঘটিত নানা রোগ। টাইফয়েড, মৌসুমি ফ্লু কিংবা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা—এদের উপসর্গ একে অপরের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রেই পরীক্ষায় ফলাফল নেগেটিভ এলেও উপসর্গ থেকে যাচ্ছে।

জ্বর থেকে বাঁচতে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এগুলো হলো: ঘুমের সময় মশারি ব্যবহার এবং বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বিশেষ করে এডিস মশা জন্মায় এমন স্থানে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে। মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। অন্য ব্যক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হবে। জনবহুল এলাকায় গেলেও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

চট্টগ্রাম অফিস থেকে মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন জানান, জেলায় মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ে ঝুঁকি বেড়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে চিকুনগুনিয়ার ব্যাপকতা বেড়েছে। চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চলতি মাসে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। চিকুনগুনিয়ায় কোনো মৃত্যু না হলেও আক্রান্তের হার অতি মাত্রায় বেড়েছে। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এর শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু হয়নি। শুধু বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকুনগুনিয়া শনাক্তের পরীক্ষা করা হচ্ছে।

এডিস মশাবাহিত রোগের জন্য চট্টগ্রাম নগরীকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। চলতি জুলাই মাসে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এছাড়া আইইডিসিআরের সুপারিশগুলো সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত বছর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগ একই ধরনের এক জরিপ পরিচালনা করে। দুই প্রতিষ্ঠানের তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, এবার এডিস মশার প্রজনন ও লার্ভার ঘনত্ব—দুটোই বেড়েছে।

মশাবাহিত এই দুই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এর মধ্যে আবার জেলায় তিন জনের শরীরের জিকা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার তথ্য দিয়েছে আইইডিসিআর। চিকিৎসকরা জানান, জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাতে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস নাকি ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে, তা শনাক্ত করা সম্ভব হবে। ফলে রোগী যথাযথ চিকিৎসা পাবে। নইলে ঝুঁকি বাড়তে পারে।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে ও চেম্বারে চিকুনগুনিয়ার রোগী আসছে। এই জ্বরে আক্রান্তদের জ্বর চলে যাওয়ার পরও ১৫-৩০ তিন পর্যন্ত শরীরে ব্যথা থাকে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে খুব কষ্ট হয়। হাঁটাচলা করতেও ব্যথার কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয়।

চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিকুনগুনিয়ায় কোনো মৃত্যু নেই। এখন বর্ষাকাল বৃষ্টি হচ্ছে। জমে থাকা পানিতে এডিস মশার প্রজনন বেড়েছে। তাই জ্বর হলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। ডেঙ্গু শনাক্ত হলে রোগীকে প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না।

তিন দিনের বেশি জ্বর থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে :অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ, জ্বরকে অবহেলা করলে ভয়ের কারণ হতে পারে: ডা. লেলিন চৌধুরী