Last Updated on 3 weeks by zajira news
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: মিসর ও জর্ডান মনে করছে, তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তাঁর গাজা দখলের পরিকল্পনা থেকে নিরস্ত করতে সফল হয়েছেন। তিনি শুধু গাজা দখল নয়, সেখানকার ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে চান।
মিসরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, তাঁদের প্রস্তাবিত গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী বিকল্প পরিকল্পনা সম্পর্কে ট্রাম্পকে জানানো হয়েছে। এতে তাঁদের সায় আছে বলে মনে হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আরব বিশ্বের সমর্থনে মিসর গাজা নিয়ে একটি বিকল্প পরিকল্পনা তৈরির কাজ করছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই পরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিসরের ওই কর্মকর্তা গতকাল মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বলেন, জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ ওয়াশিংটন সফরকালে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে আলাপ করেন। এই পরিকল্পনায় ট্রাম্পকে রাজি করানোর ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কায়রো ও আরব বিশ্ব ট্রাম্পের সঙ্গে জর্ডানের বাদশাহর বৈঠককে প্রাথমিক বিজয় হিসেবে দেখছে।
ট্রাম্পের গাজা উপত্যকা দখলের প্রস্তাব নিয়ে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ প্রকাশ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কোনো সমালোচনা করেননি। তবে মিসরের কর্মকর্তা বলেন, বাদশাহ আবদুল্লাহ ট্রাম্পের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে তাঁকে সতর্ক করে বলেছেন, তাঁর এই পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যে ‘ইসলামি উগ্রপন্থাকে’ উসকে দিতে পারে। তাতে হিতে বিপরীত হবে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষের সরকারগুলো টালমাটাল অবস্থায় পড়ে যেতে পারে।
মিসরের ওই কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ওই রুদ্ধদ্বার বৈঠক থেকে দারুন ফলাফল এসেছে। মিসরের কর্মকর্তা আরও বলেন, বাদশাহ আবদুল্লাহর বক্তব্য খুব ‘মনোযোগ সহকারে এবং সহানুভূতির’ সঙ্গে শোনেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ট্রাম্পের সঙ্গে বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহর বৈঠকের সুফলকে আরও সামনে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি মিসর। তারা আরও জীবিত ছয় ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্ত করতে গাজার ক্ষসতাসীন হামাসের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যায়। এতে সাফল্যও আসে। অস্ত্রবিরতি চুক্তিকে আরও পাকাপোক্ত করতে এই জিম্মি মুক্তি বেশ কাজে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মিসরের কর্মকর্তা বলেন, হামাস মিসরের জিম্মি মুক্তির প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। তবে এতে তাদেরও একটি শর্ত বাস্তবায়ন হতে চলেছে। বিনিময়ে গাজার পুনর্গঠনে ভারী যন্ত্রপাতি উপত্যকায় প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে ইসরায়েল।
পাশাপাশি ইসরায়েল গাজায় ভ্রাম্যমাণ বাড়ি ঢোকারও অনুমতি দিয়েছে। এসব ভ্রাম্যমাণ বাড়ি গাজায় ঢুকতে গেলে ইতিপূর্বে বাধা দিয়েছিল ইসরায়েল। এর আগে হামাস অভিযোগ তুলেছিল, ইসরায়েল গাজায় খাদ্যসহায়তা ঢুকতে না দিয়ে অস্ত্রবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করছে। এ জন্য জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়েছিল তারা।
মিসরের কর্মকর্তা বলেন, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি আগামীকাল বৃহস্পতিবার সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ সফরে যেতে পারেন। গাজা যুদ্ধ-পরবর্তী সরকার কেমন হবে, সেটা নিয়ে তিনি সেখানে আলোচনা করবেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স প্রথমে সিসির সৌদি সফর নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
ট্রাম্পের গাজা দখল এবং সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের প্রস্তাব ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বে সমালোচনা শুরু হয়েছিল। ট্রাম্পের এমন বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্রদেরও হতাশ করেছিল। তারা মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা এবং গাজায় ব্যাপক ইসরায়েলি আগ্রাসনের আশঙ্কা করছিল।
কূটনীতিক ও বিশ্লেষকেরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা দখলের ঘোষণা নিয়ে বেশ ধন্দে ছিলেন। ট্রাম্প কি সত্যিই গাজা দখল করতে চান নাকি আরব বিশ্ব থেকে নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য এই হুমকি দিয়েছেন, তা নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশায় ছিলেন তাঁরা। ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের গাজার নিয়ন্ত্রণ পরের বিষয়। তার আগে আরব দেশগুলোর বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া উচিত।
এর পর থেকেই মিসরের পরিকল্পনা বেশ গতি পেতে থাকে। মনে হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টকেও এই পরিকল্পনা বেশ প্রভাবিত করেছে।
গত সোমবার ইসরায়েল সফরকালে রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেন, যেকোনোভাবেই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের গাজা দখলের ‘খুব একটা আগ্রহ’ নেই।
ডেমোক্র্যাট সিনেটর রিচার্ড বুমেন্থাল বলেন, জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ তাঁকে বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আরব রাষ্ট্রগুলোর একটা পরিকল্পনা আছে। তবে এ জন্য আগে ফিলিস্তিনিদের স্বশাসনের বিষয়টি ঠিক করতে হবে। এরপরই ইসরায়েলের সঙ্গে এই অঞ্চলের নিরাপত্তায় প্রতিরক্ষা চুক্তি হতে পারে।
ট্রাম্পের গাজা দখলের ঘোষণার পর ইসরায়েলও হুমকি দিয়েছিল। তারা ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে অন্য কোথাও ‘স্বেচ্ছায় অভিবাসী’ হতে বলা শুরু করেছিল। তবে ইসরায়েল এও বলেছে, ‘চলতি সপ্তাহে’ গাজায় যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরু হবে। এতে যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার শাসন নিয়েও কথা হবে।
আরব রাষ্ট্র ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ) যুদ্ধ–পরবর্তী গাজা উপত্যকার শাসন নিয়ে কয়েকটি পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছে। এতে ফিলিস্তিনের ভেতর ও বাইরে থেকে গাজায় সরকার পরিচালনার কথা বলা হয়েছে, তবে সবই হবে হামাসকে বাদ দিয়ে। পিএ ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফকে বলেছে, গাজা উপত্যকায় একটা সরকার প্রতিষ্ঠা করতে তারা প্রয়োজনে হামাসের মুখোমুখি হতেও প্রস্তুত।

মিসরের কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, মিসরের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য কোনো ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষের প্রয়োজন নেই। কারণ, হামাস গাজায় নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে নিজেদের দূরে রাখতে সম্মত হয়েছে। তবে তাদের একটিই শর্ত, ওই সরকারে পিএর জ্যেষ্ঠ কোনো কর্মকর্তাকে রাখা যাবে না।
গতকাল বার্তা সংস্থা এপির এক খবর বলা হয়েছে, মিসরের যুদ্ধ–পরবর্তী গাজা পরিকল্পনায় হামাস বা পিএর কোনো কর্মকর্তাকে রাখা হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, পিএ পুলিশ বাহিনীর যে অংশ ২০০৭ সাল থেকে গাজায় দায়িত্ব পালন করছে, তারাই গাজা পরিচালনায় কাজ করবে। গাজায় ২০০৭ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে হামাস সরকার গঠন করেছিল।
মিডল ইস্ট আইয়ের গত মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গাজার ভবিষ্যৎ সরকার গঠনের প্রশ্নে হামাস কিছুটা ‘নমনীয়’ থাকবে। তাদের শর্ত হচ্ছে, গাজায় সরকার গড়বে ফিলিস্তিনিরাই। যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের আরোপিত সরকার এখানে হবে না।
তবে কথা হচ্ছে, গাজা উপত্যকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে কারা থাকবে। যেমন লেবাননে গৃহযুদ্ধের পর ১৯৯০ সালে নতুন সরকার গঠিত হয়। তবে হিজবুল্লাহ সশস্ত্র অবস্থায় রয়ে গেছে এবং রাষ্ট্রের বাইরে আলাদা সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
মিসরের ওই কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, লেবাননের মতো পরিস্থিতি যাতে এখানে না হয়, সে বিষয়টি উপসাগরীয় দেশগুলো নিশ্চিত করতে চায়। এ কারণে ‘গাজা উপত্যকায়’ তাদের সক্রিয় ভূমিকা থাকবে। গাজার পুনর্গঠনে বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা এই ভূমিকা পালন করে যাবে।
গতকাল প্রকাশিত জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ মূল্যায়নে বলা হয়েছে, গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরের পুনর্গঠনে লাগবে পাঁচ হাজার কোটি ডলার । কমপক্ষে দুই হাজার কোটি ডলার লাগবে প্রথম তিন বছরে ।