সময়ের জনমাধ্যম

দেশের ৪.৮৯ শতাংশ মানুষ মাদকাসক্ত

ছবি - এ আই

Last Updated on 6 hours by zajira news

অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: দেশে এখন মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮৩ লাখ। বেশির ভাগ পুরুষ মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তি রয়েছে নারী ও শিশুদের মধ্যেও ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) এক সমীক্ষায় মাদকাসক্ত জনসংখ্যার এই প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ ধরনের সমীক্ষা এই প্রথম করেছে ডিএনসি। এর আগে ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট একটি সমীক্ষা করেছিল, সেখানে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ৩৬ লাখ।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক গনমাধ্যমকে বলেন, মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা যদি ৮৩ লাখে পৌঁছে যায়, তবে সেটি দেশের মাদক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি নির্দেশ করে। এটা প্রমাণ করে, দেশে মাদক একেবারেই নিয়ন্ত্রণে নেই। তিনি মনে করেন, মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) দেশে পালিত হবে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘দ্য এভিডেন্স ইজ ক্লিয়ার: ইনভেস্ট ইন প্রিভেনশন। ব্রেক দ্য সাইকেল। স্টপ অর্গানাইজড ক্রাইম।’ মানে হলো, ‘প্রমাণ স্পষ্ট, প্রতিরোধে বিনিয়োগ করুন। চক্র ভেঙে ফেলুন। সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন করুন।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমীক্ষাটি শিগগিরই প্রকাশিত হবে। অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, সমীক্ষায় দেশের আট বিভাগের ১৬টি জেলা থেকে ৫ হাজারের বেশি মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে মাদকাসক্তির হিসাব তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গবেষকেরা স্বীকৃত গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন।

গবেষণার ফলাফলের অংশে বলা হয়, দেশে প্রাক্কলিত মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৮৩ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। জনসংখ্যা ধরা হয়েছে সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা শুমারি অনুযায়ী ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার।

মাদকবিষয়ক প্রতিবেদনে দেশের চারটি অঞ্চলের ১০৪টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ৮ জেলার ৪৩টি, পূর্বাঞ্চলের ৪ জেলার ২১টি, উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার ২১টি এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারের ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমীক্ষা অনুযায়ী, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষ ৭৭ লাখ ৬০ হাজার এবং নারী ২ লাখ ৮৫ হাজার। এর বাইরে ২ লাখ ৫৫ হাজার শিশু-কিশোর মাদকে আসক্ত।

মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৬১ লাখ গাঁজায় (প্রায় ৫২ শতাংশ), ২৩ লাখ ইয়াবায় (প্রায় ২০ শতাংশ) ও ২০ লাখ ২৪ হাজার মদ্যপানে (১৭ শতাংশ) আসক্ত। ৩ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি মানুষ ফেনসিডিল ও সমজাতীয় মাদকে এবং ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ হেরোইনে আসক্ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, তিন লাখের মতো মানুষ ঘুমের ওষুধ মাদক হিসেবে গ্রহণ করেন। ড্যান্ডির মতো আঠাকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করেন ১ লাখ ৬০ হাজারের মতো মানুষ। শিরায় মাদক গ্রহণ করেন প্রায় ৩৯ হাজার মানুষ। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১ কোটি ১৭ লাখের মতো। তবে একই ব্যক্তি একাধিক মাদকে আসক্ত। সেটা বিবেচনায় নিয়ে এই হিসাব তৈরি করা হয়েছে। ফলে মোট মাদকাসক্ত দাঁড়িয়েছে ৮৩ লাখ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) হাসান মারুফ গনমাধ্যমকে বলেন, ২০১৮ সালে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপের পর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই সময়ে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে এবং মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। তিনি বলেন, অধিদপ্তরের সীমিত সম্পদ ও সুবিধা দিয়েই মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

মাদকবিষয়ক প্রতিবেদনে দেশের চারটি অঞ্চলের ১০৪টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের ৮ জেলার ৪৩টি, পূর্বাঞ্চলের ৪ জেলার ২১টি, উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার ২১টি এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারের ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।

গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরু থেকে দেশে ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে ফেনসিডিল আসা শুরু হয়। পরে ফেনসিডিলের জায়গা নেয় ইয়াবা। মিয়ানমার থেকে এখনো প্রচুর ইয়াবা আসে। পাশাপাশি নতুন করে আসা শুরু হয়েছে ক্রিস্টাল মেথ, যা মূলত ইয়াবার মূল উপাদান।

দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। তবে অভিযোগ রয়েছে, মাদকের ছোট ব্যবসায়ী, বিক্রেতা ও মাদকসেবীদের বেশি ধরা হয়। আড়ালে থেকে যান বড় মাদক ব্যবসায়ীরা। আবার মাদক মামলার তদন্ত ও সাক্ষ্যদান ঠিকমতো হয় না বলে বড় অংশের মামলায় আসামি খালাস পেয়ে যান। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৬৯৮টি মাদক মামলার রায় হয়েছে, তার মধ্যে ৫৫ শতাংশ মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন।

মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস সামনে রেখে গতকাল বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, দুটি জিনিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এক, মাদক; দুই, দুর্নীতি। তবে আগের চেয়ে মাদকের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের বেশি ধরা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শুধু মাদক বহনকারীদের ধরা হয়; গডফাদারদের ধরা হচ্ছে না।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা যা চেয়েছেন, তা-ই দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটা প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। এখন আর মাদক বহনকারীকে ধরে লাভ নেই। ধরতে হবে গডফাদারদের।’ যাঁরা মাদকাসক্ত, তাঁদের মধ্যে বড় অংশই তরুণ-যুবক। ফলে চিকিৎসার মাধ্যমে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকের বিস্তারের ফলে তরুণদের একাংশের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। পরিবারে অশান্তি বাড়ে। মাদকাসক্তরা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। তাঁরা নানা রোগে আক্রান্ত হন। মাদকাসক্তি ও রোগের চিকিৎসায় বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। মাদক চোরাচালানে দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার হয়।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতিবছর পাচার হয়ে যায় ৪৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা)। আর মাদক কেনাবেচা করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম।

মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্রের প্রয়োজন। তবে দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। ঢাকার কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রসহ চার বিভাগীয় শহরের চারটিতে একসঙ্গে মাত্র ১৯৯ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এ ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় মানসিক হাসপাতালে ৫০টি শয্যা এবং পাবনা মানসিক হাসপাতালে ৩০টি শয্যা রাখা হয়েছে মাদকাসক্তিজনিত বিষয়ে মানসিক রোগীর জন্য। অর্থাৎ সরকারি পর্যায়ে মাত্র ২৭৯ জন রোগীকে ভর্তি করে একসঙ্গে সেবা দেওয়া যায়।

অবশ্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ৩৮৭টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। নতুন করে সরকারিভাবে ঢাকায় ২৫০ শয্যার এবং দেশের বাকি ৭টি বিভাগে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট আরও ৭ পূর্ণাঙ্গ মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মনোরোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আহমেদ হেলাল গনমাধ্যমকে বলেন, যাঁরা মাদকাসক্ত, তাঁদের মধ্যে বড় অংশই তরুণ-যুবক। ফলে চিকিৎসার মাধ্যমে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি। সারা দেশে মাদক নিরাময় কেন্দ্র এবং পুনর্বাসনকেন্দ্র তৈরি করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের যদি পুনর্বাসন করা না যায়, তবে তাঁরা সমাজের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবেন।

সাবেক একজন সচিব গনমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মাদকাসক্ত একজন তরুণ একটি পরিবারের ওপর কী প্রভাব ফেলে। তাঁর একমাত্র ছেলে মাদকাসক্ত হয়েছিলেন। তিনি মাদকাসক্তির কারণে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁকে দুই দফা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার ছেলের সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ ছিল। মাদকের কারণে তা শেষ হয়ে গেছে। আমার পরিবার সামাজিকভাবে হেয় হয়েছে। একটি পরিবারকে ধ্বংস করতে মাদকই যথেষ্ট।’