সময়ের জনমাধ্যম

প্রয়াণ দিবসে ফুলের শ্রদ্ধায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণ

উপাচার্য বলেন, "আমাদের চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের যে মূল চেতনা, অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা–সেটি নজরুল করে দেখিয়েছেন। এজন্য নজরুল এখনো ভীষণ প্রাসঙ্গিক।"

Last Updated on 2 weeks by zajira news

নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার (২৭ আগষ্ট) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে শ্রদ্ধার ফুলে ঢাকা তার সমাধি।

গান, আলোচনা ও ফুলের শ্রদ্ধায় দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে।

বুধবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে নজরুলের সমাধীতে ভিড় জমান কবির পরিবারের সদস্য ও অনুরাগীরা। আয়োজন করা হয় আলোচনা সভা ও সংগীতানুষ্ঠান। নজরুলকে নতুন প্রজন্মের মাঝে জানাতে কেবল দিবসকেন্দ্রিক স্মরণ করাটাই যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেন কাজী নজরুল ইসলামের নাতনী খিলখিল কাজী।

তিনি বলেন, “নজরুল কতটা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গেছেন, তা নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে।”

বাংলা ১৩০৬ সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি নজরুল ইসলাম। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তাকে বাংলাদেশে এনে নাগরিকত্ব ও জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৩৮৩ সনের ১২ ভাদ্র তিনি মারা যান।

১৯৭২ সালে নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা এবং নজরুল পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের কথাও উঠে আসে খিলখিল কাজীর বক্তব্যে।

নজরুল রচনাবলী অনুবাদ নিয়ে কিছুটা আক্ষেপও ঝরে কবীর নাতনীর কণ্ঠে। তিনি বলেন, “কাজী নজরুল ইসলামের রচনা ও সংগীত আমাদের জাতীয় সম্পদ৷ কবি নজরুলের রচনাবলী বহির্বিশ্বে পৌঁছানোর জন্য সরকারের দায়িত্বশীল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আবেদন জানাচ্ছি৷

“নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে কিছু অনুবাদ হয়েছে৷ তবে আরো ব্যাপক পরিসরে বাংলা একাডেমি থেকেও নজরুল রচনাবলী অনূদিত হতে পারত৷ কিন্তু তা হয়নি।” এদিন বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকেও নজরুলের সমাধীতে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

এ সময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের কাছে নজরুলের অনুবাদ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি গনমাধ্যমকে বলেন, “বাংলা একাডেমি থেকে সম্পাদিত নজরুল রচনাবলী প্রকাশ হয়েছে। এছাড়াও নজরুলকে নিয়ে কিছু বই প্রকাশ হয়েছে।”

রচনাবলী অনুবাদসহ নজরুলকে নিয়ে আরো বড় পরিসরে কাজ করার জন্য নজরুল ইন্সটিটিউটের মত প্রতিষ্ঠানই ‘যথাযথ’ বলে মনে করেন বাংলা একাডেমি মহাপরিচালক।

অধ্যাপক আজম বলেন, “নজরুল ইন্সটিটিউটসহ বিশেষায়িত যেসব কাঠামো আছে, এ ধরনের ইন্সটিটিউশনাল কাজের সক্ষমতা তাদের বেশি। বাংলা একাডেমি করতে পারে না, তা নয়। বাংলা একাডেমিও কিছু কাজ করছে। তবে তারা (নজরুল ইন্সটিটিউট) যেহেতু নজরুলকে নিয়ে কাজ করার জন্যই নিবেদিত, তারা এটা ব্যাপকভাবে করতে পারে।”

নজরুল ইন্সটিটিউট থেকেও কিছু উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে মোহাম্মদ আজম বলেন, “নজরুলকে নিয়ে কিছু অনুবাদের কাজ নজরুল ইন্সটিটিউটে হচ্ছে। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি বলেছি, তারা যেন কাজ করতে গিয়ে তাড়াহুড়ো না করে। কারণ এ ধরনের কাজ তাড়াহুড়োতে ভালো হয় না।”

শ্রদ্ধা জানাতে এসে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “নজরুলের রচনা এ দেশের মানুষের অন্যতম অনুপ্রেরণা। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকার আদায়ে যারা আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখছেন তারা নজরুলের চেতনার উত্তরসূরি।”

নজরুল তার লেখার মধ্য দিয়ে গোটা জাতিকে যে চেতনা দিয়েছেন, সেই চেতনাকে ধারণ করেই বিএনপি কাজ করছে বলে দাবি করেন রিজভী।

ভাষাবিদ, শিক্ষক ও গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, “নজরুল নিজেই বলেছেন, ‘অমর কবি হওয়ার জন্য আমি আসিনি। আমার কাজ হচ্ছে যুগের প্রয়োজন মেটানো’। তিনি ভেবেছিলেন, যুগ কেটে গেলে আমরা হয়তো তাকে মনে রাখব না।

“কিন্তু আমরা তো তাকে মনে রেখেছি। তার যুগ তো কেটে গেছে আরো আগে। আজও আমরা তাকে মনে রেখেছি, স্মরণ করছি। তার জীবনের একটি দিক হল, তিনি তার সময়ের সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, নজরুল ইন্সটিটিউট, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, নজরুলসংগীত শিল্পী সংস্থা, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, নজরুল প্রমিলা পরিষদ, জাতীয়তাবাদী লেখক ফোরাম, নজরুল একাডেমি, জাসাস, বাঁশরী- নজরুল চর্চা কেন্দ্র, শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি সংগ্রহশালা, জিয়া শিশু কিশোর মেলার পক্ষ থেকে নজরুলের সমাধীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। কেউ কেউ মোনাজাতও করেন। সমাধি প্রাঙ্গণে ‘বাগিচায় বুলবুলি’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’সহ কয়েকটি গান পরিবেশন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিল্পীরা। উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, “অসাধারণ বৈচিত্র্যময় জীবন নজরুলের। সাংবাদিক ছিলেন, রণাঙ্গনের যোদ্ধা ছিলেন। সাহিত্যে যেখানে হাত দিয়েছেন- সোনা ফলিয়েছেন। জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেছেন।

“নজরুলের যে বহুমুখি জীবন এবং বৈচিত্র্য, তা কীভাবে আমাদের একাডেমিক এবং প্র্যাক্টিসিং জীবনে চর্চা করব, তা নিয়ে ভাবতে হবে।”

নজরুল সর্বদাই বিরাজমান আছেন মন্তব্য করে অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ বলেন, “নজরুলের গান বা কবিতার চরণ আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে না, এমন দিন বিরল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা নজরুল চর্চা বাড়ানোর নানা কাজ করছি।”

উপাচার্য বলেন, “আমাদের চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের যে মূল চেতনা, অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা–সেটি নজরুল করে দেখিয়েছেন। এজন্য নজরুল এখনো ভীষণ প্রাসঙ্গিক।”

শৈশবে পিতৃহারা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় গ্রামের মক্তবে। পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ নেন।

রাঢ় বাংলা (বর্ধমান-বীরভূম) অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গীক লোকনাট্য লেটো দলে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যে নজরুলের শিক্ষকতার সমাপ্তি ঘটে। ওই সময়ই তাৎক্ষণিক কবিতা ও গান লেখার দক্ষতার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।

১৯১০ সালে লেটো গানের দল ছেড়ে দিয়ে প্রথমে রানীগঞ্জ সিয়ারসোল স্কুল এবং পরে মাথরুন স্কুলে (নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউশন) ভর্তি হলেও আর্থিক অনটনের কারণে আবারও আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নিতে হয় নজরুলকে। সেখানেই আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

রফিজউল্লার আগ্রহে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন নজরুল। সেখানে এক বছর ছিলেন তিনি। সেই ত্রিশালেই নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রবেশিকা শেষ না করেই ১৯১৭ সালের শেষ দিকে স্কুল ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নজরুল। ১৯২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর চলে তার সেই সামরিক জীবন।

১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’। ব্রিটিশ রাজের ভিত কেঁপে উঠেছিল তার অগ্নিগর্ভ কবিতার বজ্রনির্ঘোষে। ব্রিটিশবিরোধী লেখার জন্য বেশ কয়েকবার কারারুদ্ধ হতে হয় তাকে। একে একে প্রকাশিত হতে থাকে তার গ্রন্থ অগ্নিবীণা, প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, ছায়ানট, বিষের বাঁশি, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, ব্যথার দান, ঘুমের ঘোরে, মৃত্যুক্ষুধা।

নজরুল প্রতিভার আরেকটি দিক প্রভা ছড়িয়েছে সংগীতে। শ্যামা সংগীত ও ইসলামী গজল- দুই ধারাতেই সমান দক্ষতা দেখানো নজরুলের লেখা গানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি।

সৈনিক জীবনের সমাপ্তির পর নজরুলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমদের সঙ্গে। সে সময় তিনি সাপ্তাহিক লাঙ্গল, গণবাণী, ধূমকেতু, সওগাত ও সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন।

নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।

১৯২১ সালে কুমিল্লায় প্রমীলা দেবীর সঙ্গে পরিচয়ের তিন বছর পর পরিণয়। কবি পরিবারে আসেন কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ।

১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ বাকশক্তি হারান নজরুল। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুল হন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।

বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে নজরুলকে সম্মানসূচক ‘ডিলিট’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় নজরুলকে।

সে বছরই ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় মানবতা ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পাশে জাতীয় মর্যাদায় কবিকে সমাহিত করা হয় ।

Reendex

Must see news