Last Updated on 8 months by zajira news
নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ১১ বছর আগে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে আলোচনায় এসেছিল । কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ ও নারী নীতির বিরোধিতা করাসহ ১৩ দফা দাবি তুলে হেফাজতে ইসলাম ওই কর্মসূচি নিয়েছিল।
২০১৩ সালের ৫ মে দিনভর উত্তেজনা ও সহিংসতা ছড়িয়েছিল সংগঠনটির ওই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে। সেই রাতে রাজধানীর অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের শাপলা চত্বর ঘিরে তৈরি হয়েছিল এক ভীতিকর পরিবেশ। শেষ পর্যন্ত পুলিশ–র্যাব ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির অভিযানে খালি করা হয়েছিল শাপলা চত্বর।
২০১০ সালে সংগঠনটির তৎপরতা শুরু হয়েছিলো। কিন্তু ২০১৩ সালের ৫ই মে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বিশাল সমাবেশ করে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিলো কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক এই সংগঠনটি। বিশেষ করে শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সময় হেফাজতের এই আবির্ভাব স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচিত এক ঘটনা বলেই মনে করেন অনেকে।এরপর অন্তত আট বছর নানাভাবে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের বেশ কিছু দাবি দাওয়া আদায়ও করে নিয়েছিলো তারা।
কিন্তু পরবর্তীতে ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের সময় সহিংসতায় জড়িয়ে পড়া, ঢাকায় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করা এবং এ বিরোধিতায় নেতৃত্ব দেয়া মামুনুল হক ঢাকার একটি রিসোর্টে এক নারী সহ আটকের ঘটনার জের ধরে অনেকটা সংকটে পড়ে যায় সংগঠনটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, “এসব ঘটনার জের ধরে তৈরি হওয়া সংকট কাটিয়ে উঠতে না পেরে দফায় দফায় সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন এই সংগঠনের নেতারা। আমি মনে করি সেটিই সরকারকে সুযোগ করে দিয়েছে এটিকে কব্জায় নেয়ার,”
বিভিন্ন গনমাধ্যমে জানা যায়, সেদিন ভোর পাঁচটায় ফজরের নামাজের পরই ঢাকার প্রবেশপথগুলো দখলে নিয়েছিলেন হেফাজতের নেতা–কর্মীরা। ঢাকার উত্তরে গাবতলী বাস টার্মিনাল, টঙ্গী এবং দক্ষিণে সায়েদাবাদের কাছে কাঁচপুর ব্রিজসহ রাজধানীকে ঘিরে ছয়টি প্রবেশমুখেই অবরোধ তৈরি করেছিলেন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সারা দেশ থেকে আসা বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবরোধকারীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায়। এরই মধ্যে সংগঠনটির নেতৃত্ব ঢাকার ভেতরে প্রবেশ করে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তারা।
হেফাজতে ইসলামের একজন সাবেক নেতা বলেন, অনেকটা আকস্মিকভাবেই তাঁরা ঢাকায় প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শাপলা চত্বরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর অনুমতির জন্য পুলিশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন।
৫ মে সকালে দফায় দফায় এই অলোচনা চলে। অনুমতি মেলার আগেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কয়েকটি মিছিল ঢুকে পড়ে ঢাকা নগরীতে। মিছিলগুলো শাপলা চত্বরে যাওয়ার সময় সংঘর্ষ শুরু হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাছে এবং পল্টন এলাকায়।
সে সময় পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত শাপলা চত্বরে এসে শুধু মোনাজাত করেই কর্মসূচি শেষ করার শর্তে পুলিশ অনুমতি দিয়েছিল।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও পল্টন এলাকায় সহিংসতা চলে সন্ধ্যার পরও। সেখানে হেফাজতের মিছিলে আওয়ামী লীগের একদল নেতা–কর্মী হামলা করেছিলেন বলে অভিযোগ করে আসছে সংগঠনটি। তবে আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, তাঁদের কার্যালয়ে হামলা হলে তখন সেখানে থাকা কিছু নেতা–কর্মী প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন।
৫ মে বেলা দেড়টার দিকে ঢাকার সব প্রবেশমুখ থেকে হেফাজতের নেতা–কর্মীরা গিয়ে অবস্থান নেন শাপলা চত্বরে। কিন্তু পল্টন মোড় থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের চারপাশের রাস্তায় বিভিন্ন ভবনে অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ–সহিংসতা চলতে থাকে। পুলিশও দফায় দফায় গুলি চালায়। রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছিল গোটা ওই এলাকা। দিনের এই সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহত হন।
সন্ধ্যায় শাপলা চত্বরে হেফাজতের নেতাদের বক্তব্যে সেখানে অবস্থান করার ঘোষণা আসতে থাকে। সন্ধ্যার পর রাজনৈতিক অঙ্গনেও হেফাজতের এই অবস্থানকে ঘিরে নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়। রাত সাড়ে আটটার দিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে এক বিবৃতি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়। সেই বিবৃতিতে তিনি দলীয় নেতা–কর্মীদের হেফাজতের অবস্থানে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্কও হয়েছে। তবে পরে বিএনপির নেতারা হেফাজতের সঙ্গে কোনো যোগসূত্রের অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। সেদিন জামায়াতে ইসলামীও কৌশলে সক্রিয় ছিল।
অন্যদিকে পরিস্থিতি সামলাতে আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চপর্যায়ে ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় আলোচনা করছিলেন।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফিকে লালবাগ মাদ্রাসা থেকে নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে রওনা দেয়।
কিন্তু শাপলা চত্বরের দিকে কিছুটা পথ এসে অসুস্থ এবং নিরাপত্তার অভাবের কথা বলে শাহ আহমদ শফি ফিরে যান। তিনি শাপলা চত্বরে আর আসেননি। রাতে অবশ্য জমায়েতও অনেকটা কমে গিয়েছিল। এরপর রাতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির অভিযানে হেফাজতের অবস্থান ভেঙে দিয়ে খালি করা হয় শাপলা চত্বর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দখলে নেওয়ার পর ৬ মে ভোর ৫টায় পুরো মতিঝিল এলাকায় আগের দিনের সহিংস বিক্ষোভের অনেক চিহ্নই ছড়িয়েছিল।