Last Updated on 1 year by zajira news
নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: কলার ভেলায় পানিতে ভাসছে মানুষ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি। নিম্নাঞ্চলের এক তলা ভবনের ছাদেও উঠে গেছে পানি। পানিতে ভেসে গেছে মাছের ঘের, ফসলি জমি। তুলনামূলক উঁচু রাস্তাগুলোও ডুবে যাওয়ায় আশ্রয়ের জায়গা পাচ্ছে না মানুষ।
বিদ্যুৎবিহীন অনেক এলাকা, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন, পানির নিচে এক তলা ভবন, রেল ও সড়ক যোগাযোগ বন্ধ, নিখোঁজ অনেক মানুষ
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। বর্ষাকাল পেরিয়ে শরৎ ঋতুতে পা দিতেই হঠাৎ অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে তলিয়ে গেছে দেশের উত্তর-পূর্ব, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের জেলাগুলো।
এরই মধ্যে ১০ জেলার ৬৫ উপজেলার ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৪০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার। দুর্গত এলাকার বিস্তীর্ণ অংশে বিদ্যুৎ নেই। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। ফলে খবর মিলছে না বিপদে পড়া মানুষের।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছেন, পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২ হাজার ২৪৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য মোট ৫০৬টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। দুর্গতদের জন্য নগদ অর্থ, চাল ও পর্যাপ্ত শুকনা খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বন্যায় ফেনীতে একজন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে। তবে গত দুই দিনে কুমিল্লায় আরও চারজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধি।
গতকাল আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারের মাধ্যমে গতকাল ত্রাণসামগ্রী বিতরণের লক্ষ্যে বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় পর্যবেক্ষণ মিশন পরিচালনা করা হয়েছে। যে কোনো সময় ত্রাণসামগ্রী ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিমানবাহিনীর বিমান প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিতে গতকাল মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলে বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
গতকাল সকালে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার সাতটি নদনদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সুরমা-কুশিয়ারার পানি বৃদ্ধি আজও অব্যাহত থাকতে পারে।
তবে আজকের মধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাত কমে আসতে পারে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরে উন্নতি হতে পারে।
ফেনীর বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম অংশে ও ফেনীর ফাজিলপুরে ঢাকা-চট্টগাম মহাসড়কে পানি ওঠায় সড়ক যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে। পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার পর গত পরশু রাত থেকে ফেনী শহর, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী উপজেলায়ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পানি ঢুকছে। পানির প্রবল স্রোতে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছে। পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার বাজারের পাশে উঁচু বাড়িঘর ছাড়া প্রায় সব বাড়িঘর পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এক তলা ভবনের ছাদ ডুবে গেছে পানিতে। সড়কে কোমরপানি। ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে কে কোথায় কীভাবে আছে জানারও সুযোগ নেই।
জোয়ারের পানির চাপে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটিতে পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, আমন ধানের বীজতলা, পুকুর, মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল দুপুরে ভদ্রা নদীর জোয়ারের পানির চাপে কালীনগর পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে কালীনগর, সৈয়দখালী, হরিণখোলা, দারুলমল্লিক, সেনেরবেড়সহ কয়েকটি গ্রামে ৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করছেন। পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, এরই মধ্যে বাঁধ মেরামতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
রাঙামাটির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি প্রায় অর্ধলাখ পরিবার। উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরামের পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, লংগদু উপজেলার নিম্নাঞ্চল। মানবেতর দিন কাটছে বানভাসিদের। অন্যদিকে খাগড়াছড়ি সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটক আটকা পড়েছেন প্রায় আড়াই শ জন। রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন খান বলেন, ‘বৃষ্টি হলে পাহাড়ে আতঙ্ক থাকে ধসের। আমরা পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। তাই এখনো প্রাণহানি ঘটেনি। তবে উপজেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দিদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যারা পানিতে আটকা পড়েছেন, তাদের উদ্ধার করে প্রশাসন নিরাপদে নিয়ে আসছে।’
সীমান্তবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের কারণে উপজেলার ছয়টি ও কসবা উপজেলার একটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। আখাউড়ার খলাপাড়ায় হাওড়া নদীর দুটি স্থানে বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কৃষিজমি ও পুকুর তলিয়ে গেছে। আখাউড়া-আগরতলা সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি উঠেছে। স্থলবন্দর এলাকায় পানি ওঠায় ইমিগ্রেশন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আসা পাহাড়ি ঢল, বৃষ্টির পানি ও হাওড়া বাঁধ ভেঙে সীমান্তবর্তী উপজেলার ৩৫ গ্রামে কমবেশি পানি ঢুকেছে। গাজীরবাজার এলাকায় অস্থায়ী সেতু ভেঙে স্থলবন্দরগামী সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি।
হবিগঞ্জের পাঁচ উপজেলার ২২ ইউনিয়নের ৮ হাজার ২৪০টি পরিবার বন্যার পানিতে আক্রান্ত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ৩৩ হাজার ৪৬৮ জন। গতকাল দুপুরে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সুমি রানি বল।
উজানের ঢলে আকস্মিক বন্যায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী, কমলগঞ্জ, রাজনগর ও সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের অসংখ্য ঘরবাড়ি, গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। এতে আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সড়কপথে সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে পানি কমতে শুরু করেছে বলে আশার খবর দিয়েছে পাউবো।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার প্রায় ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি বৃদ্ধি ও লাগাতার অতিবৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। ঘরবাড়ি ডুবে শতভাগ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে চরঘাসিয়া, চরজালিয়া, চরকাচিয়া, চরখাসিয়াসহ ২০টি গ্রাম। বিভিন্ন সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক শ পরিবার। অনেকে ঘরের চালে, কলার ভেলায় আশ্রয় নিয়েছে।
কুমিল্লার তিতাস উপজেলার আসমানিয়া বাজারসংলগ্ন গোমতী নদীতে নির্মিত বেইলি ব্রিজটি বানের পানির চাপে বুধবার সন্ধ্যায় ভেঙে গেছে। এতে আঞ্চলিক সড়ক দিয়ে সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। যানবাহন বন্ধ থাকায় এ অঞ্চলের ২২ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে। উপজেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে।
কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়ায় টানা বৃষ্টিতে অন্তত ১৫ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের, ধান খেত ও সবজি খেত।
চট্টগ্রামে মুষলধারে বৃষ্টি, বন্যা ও জোয়ারের পানিতে চরম ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে। হালদা ও মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তলিয়ে গেছে নগরের অধিকাংশ এলাকা। বিশেষ করে জোয়ারের সময় হুহু করে পানি ঢুকছে বিভিন্ন এলাকায়। বন্যার পানিতে ডুবেছে চট্টগ্রামের অন্তত সাত উপজেলা। বুধবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে কোমরপানিতে ডুবে যায় নগরের অনেক এলাকা। টানা বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয় মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, ফটিকছড়ি, রাউজান, হাটহাজারী, বোয়ালখালী ও সাতকানিয়া উপজেলা। এসব উপজেলার প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়। সড়ক নিচে তলিয়ে যাওয়ায় খাগড়াছড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
বন্যায় তলিয়ে গেছে নোয়াখালী পৌরসভাসহ পুরো জেলা। জেলা জামে মসজিদ, জজ কোর্ট আইনজীবী সমিতি, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টসহ জেলার নয় উপজেলার সবকটির বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। গৃহবন্দি ও পানিবন্দি হয়ে পড়ছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ।
লক্ষ্মীপুরে টানা বৃষ্টি ও উজানের পানিতে প্লাবিত হয়েছে শতাধিক গ্রাম। এতে জেলার পাঁচ উপজেলার ১ লাখ ৮২ হাজার পরিবারের ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে।