সময়ের জনমাধ্যম

বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তিপণ্য কতটা নিরাপদ: লেবাননে বিস্ফোরণ

Last Updated on 3 days by zajira news

প্রযুক্তি ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: লেবাননে গত মঙ্গলবার ও বুধবার প্রায় একযোগে হাজার হাজার পেজার (তারবিহীন যোগাযোগের যন্ত্র), মোবাইল, ওয়াকিটকি সহ বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্যের বিস্ফোরণ ঘটেছে।

বিশ্বজুড়ে এ ঘটনা এসব পণ্যের সরবরাহশৃঙ্খল–ব্যবস্থার নিরাপত্তা যাচাই এবং এ ব্যবস্থায় সরকার বা অন্য কোনো পক্ষের অবৈধ হস্তক্ষেপের ঝুঁকির বিষয়কেই সামনে তুলে এনেছে ।

লেবাননে দৃশ্যত যে হামলা হয়েছে, তা দেশটির সশস্ত্র হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইসরায়েলি অভিযানের অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। এই ঘটনা এখন নিত্যব্যবহার্য যোগাযোগের উপকরণ ভবিষ্যতে অস্ত্রে পরিণত হওয়ার শঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলেছে।

প্রযুক্তিশিল্প ও পণ্য সরবরাহব্যবস্থা–বিষয়ক বিশ্লেষকেরা আল–জাজিরাকে বলেছেন, লেবাননে ওই হামলা প্রযুক্তিপণ্য সরবরাহব্যবস্থার নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তাকে বিশেষভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। সেই সঙ্গে তাঁরা এ–ও ধারণা করছেন, এ ঘটনা প্রযুক্তিপণ্যের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থায় চিড় ধরাতে পারে।

কাউকে না জানিয়ে হাজার হাজার যন্ত্র যেকোনো প্রকারে হোক, অস্ত্রে পরিণত হলো। এই বিস্ফোরক যন্ত্রগুলোর বিস্তৃতি কতটা, কীভাবে যন্ত্র বা যন্ত্র সরবরাহশৃঙ্খল–ব্যবস্থায় বিস্ফোরক ঢুকে পড়ল—এমন সব ভয়ানক প্রশ্নের উদয় হয়েছে ওই ঘটনায়; যা আগে কখনো বিবেচনা করা হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল টেক ও কর্নেল ল স্কুলের ডিজিটাল অ্যান্ড ইনফরমেশন ল–এর অধ্যাপক জেমস গ্রিমেলম্যান বলেন, ‘যন্ত্র নির্মাতা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি এখন তাদের পণ্যের সরবরাহশৃঙ্খল–ব্যবস্থার শুদ্ধতার ব্যাপারে চিন্তায় পড়বে।’

এই বিশ্লেষক বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য এবং এর সরবরাহশৃঙ্খল–ব্যবস্থায় বাড়তি নিরাপত্তা ও যাচাই কার্যক্রম যুক্ত করার বিষয় বিবেচনা করতে পারে; যাতে এমন ঘটনা (লেবাননে বিস্ফোরণ) আরও ভালোভাবে শনাক্ত ও প্রতিরোধ করা যায়।’

বিকৃত করা যোগাযোগের যন্ত্র ব্যবহার করে আগেও গুপ্তহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল। বিস্ফোরকভর্তি মোবাইল ফোনের সাহায্যে ১৯৯৬ সালে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের বোমা প্রস্তুতকারী ইয়াহিয়া আয়াশকে মেরে ফেলা ছিল ওই হত্যাকাণ্ডগুলোর একটি। কিন্তু লেবানেন যেভাবে দুদিনে প্রযুক্তিপণ্যের যুগপৎ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল, তা একেবারেই নজিরবিহীন।

লেবাননে ওই বিস্ফোরণে অন্তত ৩২ জন নিহত ও ৩ হাজার ১০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে হিজবুল্লাহর সদস্যরা যেমন রয়েছেন, তেমন বেসামরিক লোকজনও রয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।যন্ত্র নির্মাতা ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি এখন তাদের পণ্যের সরবরাহশৃঙ্খল–ব্যবস্থার শুদ্ধতার ব্যাপারে চিন্তায় পড়বে।

ব্রায়ান প্যাট্রিক গ্রিন যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটির মার্ককুলা সেন্টার ফর অ্যাপ্লায়েড এথিক্সের প্রযুক্তি নৈতিকতা বিভাগের পরিচালক, লেবাননে বিস্ফোরণের ঘটনাকে প্রযুক্তিপণ্যের ওপর মানুষের আস্থার ক্ষেত্রে এক সম্ভাব্য সন্ধিক্ষণ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।

প্যাট্রিক গ্রিন বলেন, কাউকে না জানিয়ে হাজার হাজার যন্ত্র যেকোনো প্রকারে হোক, অস্ত্রে পরিণত হলো। এই বিস্ফোরক যন্ত্রগুলোর বিস্তৃতি কতটা, কীভাবে যন্ত্র বা যন্ত্র সরবরাহশৃঙ্খল–ব্যবস্থায় বিস্ফোরক ঢুকে পড়ল—এমন সব ভয়ানক প্রশ্নের উদয় হয়েছে ওই ঘটনায়; যা আগে কখনো বিবেচনা করা হয়নি।

এ বিষয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল এথিক্স ও ডিফেন্স টেকনোলজির অধ্যাপক মারিয়ারোসারিয়া ট্যাডেও বলেন, এই বিস্ফোরণের ঘটনা পণ্য সরবরাহশৃঙ্খল–ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের সঙ্গে যুক্ত। এটি কোনো একটি নির্দিষ্ট অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা নয়; বরং রীতিমতো বিলিকৃত ও অতি প্রভাবযুক্ত হামলার ঘটনা। তাই এ হামলা এক উদ্বেগের নজির তৈরি করেছে।

পেজার ও ওয়াকিটকিগুলো ঠিক কীভাবে বিস্ফোরক যন্ত্রে পরিণত হলো, সেটি পরিষ্কার নয়; যদিও লেবানন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, যন্ত্রগুলোতে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দিয়েছেন ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। অবশ্য, ইসরায়েল ওই হামলার দায় স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটি করেনি।

লেবাননে হামলায় তাইওয়ানের প্রতিষ্ঠান গোল্ড অ্যাপোলোর তৈরি পেজার ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি প্রাণঘাতী হয়ে ওঠা এসব পেজার তৈরির কথা অস্বীকার করেছে।

তারা বলেছে, পেজারগুলো তৈরি হয়েছে বিএসি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অনুমতিক্রমে। হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টভিত্তিক বিএসি এই বিষয়ে মন্তব্য করার অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

অজ্ঞাত তিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে গত বৃহস্পতিবার দ্য নিউইয়র্ক টাইমস খবরে বলেছে, বিএসি একটি ইসরায়েলি ফ্রন্ট; যা বিস্ফোরক পেজার তৈরি করতে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

রেডিও সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক জাপানি প্রতিষ্ঠান আইকম বলেছে, ১০ বছর আগে কিছু হামলায় ব্যবহার করার খবরে ওই ধরনের রেডিও (রেডিও ওয়াকিটকি) তৈরি বন্ধ করে দিয়েছে তারা।

ক্যালিফোর্নিয়া পলিটেকনিক স্টেট ইউনিভার্সিটির এথিক্স প্লাস ইমার্জিং সায়েন্সেস গ্রুপের পরিচালক প্যাট্রিক লিন বলেন, সরবরাহশৃঙ্খল–ব্যবস্থার কোন পর্যায়ে লেবাননে বিস্ফোরিত যন্ত্রগুলোতে বিস্ফোরক ঢোকানো হলো, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

তিনি বলেন, যন্ত্রগুলোতে বিস্ফোরক ঢোকানো হয়েছিল, সেগুলো কি ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর আগে তৈরির সময়, নাকি হস্তান্তরকালে, নাকি সিস্টেম অপারেটর পর্যায়ে?

অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির স্কুল অব সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পণ্য সরবরাহশৃঙ্খল বিশেষজ্ঞ মিলাড হাঘানির প্রত্যাশা, লেবাননের ঘটনা বিশ্বের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সরবরাহব্যবস্থার নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে সচেষ্ট করবে।

বিকৃত করা যোগাযোগ যন্ত্র ব্যবহার করে আগেও গুপ্তহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল। বিস্ফোরকভর্তি মোবাইল ফোনের সাহায্যে ১৯৯৬ সালে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের বোমা প্রস্তুতকারী ইয়াহিয়া আয়াশকে মেরে ফেলা ছিল ওই হত্যাকাণ্ডগুলোর একটি। কিন্তু লেবানেন যেভাবে দুদিনে প্রযুক্তিপণ্যের যুগপৎ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল, তা একেবারেই নজিরবিহীন।

হাঘানি বলেন, সাধারণভাবে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এমন পরিস্থিতি নজিরবিহীন পর্যায়ের। অনেক প্রতিষ্ঠানই আগে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থাকে হয়তো এত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। আবার, অনেক প্রতিষ্ঠানের এমন হুমকি মোকাবিলা করার মতো হয়তো সক্ষমতাও নেই।

তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, অ্যাপল, স্যামসাং, হুয়াওয়ে, শাওমি ও এলজির মতো বিশ্বের প্রভাবশালী স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় কম ঝুঁকিতে আছে। কারণ হিসেবে নিজেদের তৈরি পণ্যের নিরাপত্তার প্রতি এসব বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের অধিকতর মনোযোগ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন তাঁরা।

সার্বিক বিষয়ে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির স্কুল ফর দ্য ফিউচার অব ইনোভেশন ইন সোসাইটির অধ্যাপক অ্যন্ড্রু মেনার্ড বলেন, বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী আতঙ্ক সৃষ্টি ও নিজেদের লক্ষ্য হাসিলে লেবাননের বিস্ফোরণকে একটা গ্রহণযোগ্য কৌশল হিসেবে বেছে নিতে পারে।

তিনি বলেন, এটি এক নতুন ধরনের সন্ত্রাসী প্রচারণার দুয়ার খুলে দিয়েছে; যেখানে কারও পকেটে বা তাঁর সন্তানের হাতে থাকা যন্ত্রই ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।