Last Updated on 1 year by zajira news
নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ এর প্রথম সকালটিকে এক কণ্ঠে বরণ করে নিচ্ছেন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের শতাধিক শিল্পী। জীর্ণতা ঘুচিয়ে নতুনের আহ্বানে নববর্ষকে স্বাগত জানাচ্ছেন সব শ্রেণিপেশার মানুষ। ভোরের আলো ফুটতেই রমনার বটমূলে শুরু হয় বাঙালির চিরায়ত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।
রোববার (১৪ এপ্রিল) সকাল সোয়া ৬টার দিকে আহির ভৈরব রাগে বাঁশির সুরে শুরু হয়েছে বর্ষবরণের এবারের অনুষ্ঠান। এদিন সকালের আলো ফোটার আগে থেকে রমনার বটমূলে আনাগোনা শুরু হয় রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষের।
প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এ অনুষ্ঠানমালা সরাসরি সম্প্রচার করছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, বাংলাদেশ বেতার ও ইউটিউব চ্যানেলগুলো। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ঘিরে রমনা উদ্যান ও এর আশপাশের এলাকায় জোরদার করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান।
বেলা বাড়তে বাড়তে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। রমনার সবুজের ভেতর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে লাল-সাদা রঙের স্রোত। সবাই এসেছে বাংলা ১৪৩১-কে বরণ করে নিতে। নিরাপত্তাবেষ্টনীর জন্য অনেকটা পথ তাঁদের হেঁটে আসতে হয়েছে। তাঁরা গান শুনেছেন, কবিতা শুনেছেন, আপনজনের সঙ্গে ছবি তুলে মুহূর্তটি ধরে রেখেছেন। আর তখন পুরো সময়জুড়ে বেজে চলেছে ছায়ানটের শিল্পীদের পরিবেশনায় রবীন্দ্র, নজরুল, পঞ্চকবির গানসহ বাউল গান।
রবীন্দ্রনাথের ত্রাণ ও অপমান থেকে পাঠ করে শোনালেন শিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। এরপর কাজী নজরুল ইসলামের জীবন-বিজ্ঞান থেকে পাঠ করলেন সংস্কৃতিজন রামেন্দু মজুমদার। চন্দনা মজুমদারের শোনালেন লালনগীতি। মোট ১৩টি একক, ১২টি সম্মেলক সংগীত এবং দুটি পাঠ, কথন ও যন্ত্রসংগীত পরিবেশনা নিয়ে সাজানো হয়েছে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’ জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের চিরন্তন উৎসব, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই দিন আমাদের আপন শিকড়ের প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হওয়ার দিন, বাঙালির প্রাণের উৎসবের দিন। আবহমান এই লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যে বর্ষবরণ উৎসবে মেতে ওঠে দেশের প্রতিটি শহর-গ্রাম-নগর-বন্দর। রাজধানীর বর্ষবরণের অনুষ্ঠান রমনা বটমূল থেকে ছড়িয়ে পড়ে নগরজুড়ে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বৈশাখের প্রথম দিনটিতে পুরো ঢাকা পরিণত হয় উৎসবের নগরীতে। বর্ষবরণের আনন্দ-উৎসবে মুখরিত থাকে সমগ্র দেশ। এই একটি দিনে কোনো ভেদাভেদ থাকে না বাংলার মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝে। নববর্ষের উৎসব হয়ে ওঠে সর্বজনীন।
অতীতে আমরা দেখেছি কিছু ধর্মান্ধ মানুষ সাম্প্রদায়িক বিভেদের দেয়াল তুলে দিতে চেয়েছে বর্ষবরণের উৎসবে। কিন্তু বাঙালি জাতি কোনো দিনই তা মেনে নেয়নি। সব ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই বাংলার প্রতিটি প্রান্তে, প্রতিটি ঘরে উদযাপিত হয়েছে নববর্ষের উৎসব। বাঙালির সংস্কৃতি ধ্বংসের যে অপচেষ্টা তদানীন্তন পাকিস্তানে শুরু হয়েছিল, তার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে যে আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছিল ছায়ানট, তা আজও বাঙালির এক অমলিন ঐতিহ্য। অপশক্তির বোমা হামলাও ছায়ানটের এই যাত্রাকে থামাতে পারেনি। বরং বাঙালির প্রাণের এই উৎসব আজ বিশ্ব ঐতিহ্যেরই অংশ হয়ে গেছে।
স্বাধীন দেশে বাঙালির নতুন সংকল্প আপন সংস্কৃতি অন্তরে ধারণ করে পূর্ণ মানব হয়ে ওঠা; আপন সত্তাকে জাগ্রত রেখে, শিক্ষিত ও সংস্কৃতি-সচেতন মানবিক জনপদ গড়ে তোলা। কিন্তু আজ, ভোগবাদ ও রক্ষণশীলতার দাপটে আমরা নতুন সংকটের সম্মুখীন। হারাতে বসেছি বাঙালির স্বাভাবিকতা।
আলগা হয়ে পড়ছে পারস্পরিক সম্প্রীতির বাঁধন। বিস্তার ঘটছে লোভ এবং স্বার্থপরতার। চেনা মানুষও হয়ে উঠছে অচেনা। তৈরি হচ্ছে এক অস্বাভাবিক এবং অসহিষ্ণু সমাজ।