সময়ের জনমাধ্যম

মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার কারণ কী হতে পারে

প্রায় দেড় শ কেজি ওজনের ওই বস্তু পড়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে

Last Updated on 2 weeks by zajira news

অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: এক বছরের ব্যবধানে ঢাকার মেট্রোরেলে একই ধরনের দুর্ঘটনার পর অনেকের কৌতূহল এখন বিয়ারিং প্যাড নিয়ে।

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। ওই ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। তবে ট্রেন চলাচল ১১ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। ওই দুর্ঘটনার পর বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হয়।

তারপর আজ রোববার (২৬ অক্টোম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফার্মগেটে পুনরায় বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা ঘটে। প্রায় দেড় শ কেজি ওজনের ওই বস্তু পড়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এরপর মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত চলাচল শুরু হলেও মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল এখনো বন্ধ।

মেট্রোরেলের ‘বিয়ারিং প্যাড’ হচ্ছে রাবার ও ইস্পাতের মিশ্রণে তৈরি আয়তাকার একধরনের প্যাড, যা অনেকটা বিছানার মেট্রেসের মতো করে ব্যবহৃত হয়। মেট্রোরেলের উড়ালপথটিকে বলা হয় ভায়াডাক্ট। এর ওপরই রেললাইনসহ যাবতীয় স্থাপনা বসানো হয়। আবার ভায়াডাক্ট বসানো হয় স্তম্ভ বা পিলারের ওপর। এই স্তম্ভকে প্রকৌশলের ভাষায় বলা হয় পিয়ার।

মেট্রোরেলের উড়ালপথটি কংক্রিটের তৈরি, যা ৩০ থেকে ৪০ মিটার লম্বা একেকটি স্প্যান জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যেহেতু ভায়াডাক্ট ও পিয়ার দুটিই কংক্রিটের তৈরি, তাই দুটি কংক্রিটের বস্তুর একটির ওপর আরেকটি স্থাপন করলে ঘর্ষণজনিত সমস্যা হতে পারে। হতে পারে ক্ষয়, ঘটতে পারে স্থানচ্যুতিও। এ জন্যই ভায়াডাক্ট ও পিলারের মাঝখানে রাবার ও স্টিলের তৈরি বিয়ারিং প্যাড দেওয়া হয়, যা স্থাপনাটির সুরক্ষায় কাজ করে।

ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। কোম্পানির সূত্র বলছে, দুই পিলারের মাঝখানের প্রতিটি স্প্যানের জন্য চারটি করে বিয়ারিং প্যাড রয়েছে; অর্থাৎ একেকটি পিলারের আছে চারটি করে রাবার প্যাড। এগুলোর স্তরে স্তরে রাবার ও বিশেষ স্টিল দিয়ে তৈরি।

পিলার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বিয়ারিং প্যাডগুলো বসানোর জন্য বেজ বা ভিত্তি রয়েছে। এটি নাট-বল্টু কিংবা অন্য কিছু দিয়ে আটকানো থাকে না; বরং পিলার ও ভায়াডাক্টের মতো ভারী বস্তুর চাপে এটি টিকে থাকে। একেকটি স্প্যানের ওজন কয়েক শ টন হবে। কেন এই দুই ভারী বস্তুর চাপের পরও এভাবে ভিত্তি থেকে ছিটকে বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ে গেল, তা সবার কাছেই বড় প্রশ্ন। কারণ, এ ধরনের ঘটনা মেট্রোরেলের ইতিহাসে অনেকটা বিরল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এর পেছনে নকশাগত ত্রুটি থাকতে পারে বলে মনে করেন ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা। মেট্রোরেলের লাইনসহ যাবতীয় নকশা প্রণয়নের দায়িত্বে ছিল জাপানের কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জোট এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক গনমাধ্যমকে বলেন, বিয়ারিং প্যাডটি বসানো হয়েছে মেট্রোর নিরাপদ চলাচল ও স্থাপনার স্থায়িত্ব ধরে রাখতে। কিন্তু এই ব্যবস্থা নিচে পড়ে মানুষ মারা গেলে তো বলতে হবে এর নকশাগত ত্রুটি থাকতে পারে। মেট্রোরেলের জন্য সবচেয়ে দামি জাপানি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাহলে তাঁদের নকশায় কী কোনো ত্রুটি ছিল।

এই অধ্যাপক বলেন, মেট্রোরেলের চলাচলের কারণে কম্পনজনিত ভার তৈরি হয়। এটা তো যেকোনো প্রকৌশলীর জানার কথা। এর জন্য যেখানে নাট-বল্টু থাকে, সেগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু মেট্রোরেলের পিলারের ওপর তো বিয়ারিং প্যাড দেওয়া হয়েছে। তা যাতে নিচে না পড়ে যায়, সেই ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল।

ডিএমটিসিএলের কোনো কোনো কর্মকর্তা মনে করেন, মেট্রোরেলের যে স্থানটিতে দুবার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছে, সেই জায়গাটিতে বড় বাঁক রয়েছে। এ ছাড়া স্থানটি অন্য স্থানের চেয়ে কিছুটা উঁচুও। কারণ, বিজয় সরণি স্টেশনটি দোতলা, কিন্তু ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার স্টেশন তিনতলা; অর্থাৎ বিজয় সরণি থেকে আস্তে আস্তে রেলপথটি ফার্মগেটে আসতে আসতে উঁচুতে উঠে গেছে।

এটাকে অবশ্য দুর্ঘটনার কারণ বলতে নারাজ অধ্যাপক সামছুল হক। তিনি বলেন, বাঁক ও উঁচু হওয়া প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জের বিষয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য নকশা করা হয় এবং বাড়তি খরচ করতে হয়। মেট্রোরেলেও তা হয়েছে। এরপরও কেন নিরাপত্তাঝুঁকি থাকবে? এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরও বলেন, জাপানের সব স্থাপনা ‘সিক্স সিগমা কমপ্লায়েন্স’ মেনে চলা হয়; অর্থাৎ প্রকৌশগত স্থাপনায় ১০ লাখের মধ্যে একটা ভুল হতে পারে। সেই জাপানি প্রযুক্তি, পরামর্শক এবং ঠিকাদারের মাধ্যমে করা মেট্রোরেলে একাধিকবার কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটে? এর জন্য একটি স্বাধীন নিরাপত্তা অডিট করা দরকার।

ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, গত বছর যে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, ওই একই স্থানে আজকের ঘটনা ঘটেনি। আজকে ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছে, যা ফার্মগেট স্টেশনের ঠিক পশ্চিম পাশে। গত বছর ৪৩০ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। মেট্রোরেলে (মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত) মোট পিলার আছে ৬২০টি। প্রতিটি পিলারে চারটি করে বিয়ারিং প্যাড আছে। সে হিসেবে মেট্রোরেলে মোট বিয়ারিং প্যাড আছে ২ হাজার ৪৮০টি।

এ বিষয়ে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ গনমাধ্যমকে বলেন, ‘কেন বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ল, তা তদন্ত করা হবে। কার দায়দায়িত্বে অবহেলা আছে, তা–ও বের করা হবে। নকশায় ত্রুটি থাকার বিষয়টিও নাকচ করছি না। সবকিছুই তদন্ত করে বের করা হবে।’

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, এ ঘটনার তদন্তে সেতুসচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনাটি কি নাশকতা, না নির্মাণত্রুটির কারণে হয়েছে, সেটা খুঁজে বের করা হবে।

বর্তমানে সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে রাত ১০টার পরও মেট্রোরেল চলাচল করছে। দিনে গড়ে সাড়ে চার লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন মেট্রোরেলে। গুরুত্বপূর্ণ এই গণপরিবহন বন্ধ থাকলে ঢাকায় যানজট যেমন বাড়ে, তেমনি ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। গত বছর বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার পর মেট্রোরেল চলাচল ১১ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় বন্ধ হওয়ার আড়াই ঘণ্টা পর আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত চলাচল শুরু হলেও মতিঝিল পর্যন্ত কখন চালু হবে, তা বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, পড়ে যাওয়া বিয়ারিং প্যাড পুনরায় স্থাপন করার মতো হলে একধরনের সময় লাগবে, আবার নতুন বিয়ারিং প্যাড লাগাতে হলে বেশি সময় লাগবে। এ ছাড়া বাড়তি বিয়ারিং প্যাড আছে কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন।

২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রথম মেট্রোরেল চালু হয়। শুরুতে চলাচল করত উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। পর্যায়ক্রমে স্টেশনের সংখ্যা বাড়ে। মতিঝিল পর্যন্ত সব স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা শুরু হয় ২০২৩ সালের শেষ দিনে। এখন কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের কাজ চলছে।

২০১২ সালে অনুমোদনের সময় মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেলের পথ নির্মাণে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে; যা আশপাশের দেশের তুলনায় অনেক বেশি, বিশ্বেই অন্যতম শীর্ষে। এমন একটা ব্যয়বহুল গণপরিবহনের নিরাপত্তাঝুঁকি থাকাটাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করেন অধ্যাপক সামছুল হক। সূত্র, দৈনিক প্রথম আলো