সময়ের জনমাধ্যম

যেভাবে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হয়ে ওঠেন সুব্রত বাইন

Last Updated on 4 weeks by zajira news

নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: ঢাকার অপরাধজগতের দীর্ঘদিনের ত্রাস, কথিত ‘সেভেন স্টার’ বাহিনীর প্রধান সুব্রত বাইনকে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করেছে।

মঙ্গলবার (২৭ মে) ভোরে কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকায় প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী শ্বাসরুদ্ধকর এক অভিযানে সহযোগীসহ তাকে আটক করা হয়।

৯০ দশকের ঢাকার ত্রাস সুব্রত বাইন গ্রেফতারের খবরের পর চারিদিকে প্রশ্ন উঠেছে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কে এই সুব্রত বাইন?

মূলত ৯০ দশকে ঢাকার অপরাধ জগতে এক ত্রাসের নাম ছিল সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী। ঢাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর আদি নিবাস বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার জোবারপাড় গ্রামে। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ১৯৬৭ সালে জন্ম সুব্রত বাইনের। তার বাবা বিপুল বাইন একটি এনজিওর গাড়ি চালাতেন। মায়ের নাম কুমুলিনি বাইন। তিন বোন আর এক ভায়ের মধ্যে সুব্রত সবার বড়। মা কুমুলিনি আর তিন বোন মেরি, চেরি ও পরীকে নিয়ে ঢাকার মগবাজারের ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি।

বহুদিন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপিয়ে ভারতের কারাগারে কিছু দিন বন্দী ছিলেন এই শীর্ষ সন্ত্রাসী। সুব্রত বাইনের অপরাধ জগতে প্রবেশ মূলত নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। ঢাকায় দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে তার উত্থান ঘটে। সেই সময় অসংখ্য খুন ও জখমের ঘটনায় তার নাম নিয়মিত আসত। একাধিকবার কারাগারে গেলেও জামিনে মুক্ত হয়ে অপরাধে ফিরে আসেন বারবার।

সুব্রত বাইন বরিশালে অক্সফোর্ড মিশন স্কুল নামে খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেন। সেখানে হোস্টেলে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও খুব বেশি ভালো ছিলেন না ছাত্র হিসেবে। এরপর ঢাকায় শেরেবাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হলে সেখান থেকেই এসএসসি পরীক্ষা দেন তিনি। তার পড়ালেখার গল্পটা এতটুকুই। এরপর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে সেখানকার এক নেতার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর কলেজে আর ভর্তি হওয়া হয়নি তার। এখান থেকেই শুরু শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন গড়ে ওঠার গল্প।

কিশোর বয়সে খুব অল্প দিনেই রাজধানীর মগবাজার এলাকায় একটি সন্ত্রাসী চক্র গড়ে তোলেন সুব্রত। ১৯৯৩ সালের দিকে মধুবাজারে এক সবজিবিক্রেতা খুনের ঘটনায় পুলিশের তালিকায় তার নাম ওঠে আসে। এর কিছুদিন পর মগবাজারের বিশাল সেন্টার নির্মাণের সময় চাঁদাবাজি নিয়ে গোলাগুলি হয়। সেই থেকে সুব্রত বাইনের নাম গণমাধ্যমে আসতে থাকে। সুব্রত বাইন পরে বিশাল সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির নেতাও বনে যান। রমনা, মধুবাগ, কারওয়ান বাজার, মগবাজার—এসব এলাকাকে পরিণত করেন নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায়।

১৯৯১ সালে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদ হত্যার ঘটনায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। এ সময় রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন তিনি। বিএনপির হয়ে কাজ করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন এবং তার জন্মদিনে দলটির শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি সুব্রতকে ‘তারকা সন্ত্রাসী’তে পরিণত করে। পরবর্তীতে যুবলীগের লিয়াকতের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান নিয়ন্ত্রণ বিস্তার নিয়ে।

১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রিপল মার্ডার, মগবাজারের রফিক, সিদ্ধেশ্বরীর খোকনসহ বেশ কয়েকজনের খুনের ঘটনায় নাম আসে সুব্রতর। ওই সময় রমনা, মগবাজার, কারওয়ান বাজার ও মধুবাগ এলাকায় প্রায়ই গোলাগুলির ঘটনা ঘটত। তার বিরুদ্ধে সে সময় কমপক্ষে ৩০টি মামলা ছিল।

১৯৯৭ সালে নয়াপল্টন এলাকার একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসেন সুব্রত বাইনকে গ্রেফতার করেন। দেড় বছরের মতো জেলে থাকার পর তিনি জামিনে বের হন এই শীর্ষ সন্ত্রাসী। সুব্রত জেলে থাকার সময় তার স্ত্রী লুসি গ্রুপেরই এক সদস্যের প্রেমে পড়েন। জেল থেকে বেরিয়ে ঘটনা জানার পর সুব্রত নিজেই লুসিকে সেই যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেন। লুসির ঘরে সুব্রতর দুই সন্তান ছিল। পরে ১৯৯৯ সালে কুমিল্লায় বিউটি নামের এক নারীকে বিয়ে করেন সুব্রত কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় বিউটিকে ডিভোর্স দিয়ে দেন।

২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। সেই তালিকায় প্রথম নামই ছিল সুব্রত বাইনের। তাকে ধরতে ইন্টারপোলেও নোটিশ জারি করে যা এখনও বহাল রয়েছে। এরই মধ্যে সুব্রত ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় ঘাঁটি গাড়ে তোলেন। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার জামেলা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। সেই ঘরে একটি মেয়ে সন্তানও রয়েছে।

একসময় ভারতে গিয়ে জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নথিপত্র তৈরি করেন সুব্রত। এরপরও অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২০০৮ সালে কলকাতা পুলিশ তাকে আটক করে। তবে অল্প দিনের মধ্যে জামিন পেয়ে দুবাই চলে যান। সেখান থেকে ফিরে কলকাতার এক চিত্রনায়িকার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। সেই ফোন কলের সূত্র ধরে ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স তাকে ধরার চেষ্টা করলে সুব্রত নেপালের সীমান্ত শহর কাঁকরভিটায় ঢুকে পড়েন। সেখানে নেপালি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। প্রথমে তাকে পূর্ব নেপালের ভাদ্রপুর এবং পরে ঝুমকা কারাগারে নেওয়া হয়। ২০১২ সালে ৭৭ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ কেটে সেই কারাগার থেকে পালিয়ে যান। আবার কলকাতায় আসার কয়েক দিন পর ২৭ নভেম্বর বউবাজার এলাকা থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতারর করে। এরপর থেকে তিনি কলকাতার জেলেই ছিলেন। সেখানে ফতেহ আলী নাম নিয়ে ছদ্মবেশে অবস্থান করছিলেন তিনি।

কলকাতায় থাকার সময় সেখানে বসেই ঢাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন সুব্রত বাইন। সড়ক ও জনপথের বড় বড় ঠিকাদারি কাজ ভাগাভাগি করতেন। সেই চাঁদার টাকায় নদীয়ায় ৫০ বিঘা জমিসহ এক বাগানবাড়ি কেনেন। এ ছাড়া ঢাকা ও কলকাতার ব্যবসায়ীদের টাকা আদায়ের কাজটি তিনি করতেন। কলকাতার ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা ঢাকার কোনো ব্যবসায়ীর কাছে আটকে গেলে সুব্রতর লোকজন আদায় করে দিত।

পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের পরিবার আগে থাকত রাজধানীর মগবাজারে। পরে তাঁরা গাজীপুরের পুবাইল হারবাইদ নয়াপাড়ায় পাঁচ কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেন। এখন সেখানেই থাকেন সুব্রত বাইনের বাবা বিপুল বাইন ও মা কুমুলিনি বাইন। তার তিন বোন মেরি বাইন, চেরি সুপর্ণা বাইন ও সুপ্রভা পরির বিয়ে হয়েছে। চেরি ঢাকার এক হাসপাতালে আর পরি একটি ক্রিশ্চিয়ান সংস্থায় কাজ করেন।

কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা সড়কের একটি ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্রসহ তাদের গ্রেফতার করা হয়। যে বিষয়টি এখন টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে।