সময়ের জনমাধ্যম

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ

জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের ঘটনা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে ওএইচসিএইচআর। ১১৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন করা হয়েছে।

Last Updated on 2 hours by zajira news

নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকার ও সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে ।

মূলত ক্ষমতায় টিকে থাকতে আন্দোলনকারীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। স্বৈরাচারী সরকার নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে যুক্ত করে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচার মারণাস্ত্র দিয়ে গুলি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, চিকিৎসা পেতে বাধা দেওয়ার মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে সরকার।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। ১১৪ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে ওই সময়ের নৃশংসতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিগত সরকার ও শাসক দল আওয়ামী লীগকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে।

ওএইচসিএইচআরের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনটি আজ বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) জেনেভা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রতিবেদনের খসড়া দিয়েছিল। কোনো মতামত থাকলে তাতে যুক্ত করার জন্য সময়সীমা দেয় ওএইচসিএইচআর।

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দল প্রতিবেদনটি তৈরির জন্য ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, সিলেট ও গাজীপুর—এই আট শহরে অনুসন্ধান চালায়। মূলত যে শহরগুলোতে বেশি মাত্রায় বিক্ষোভ হয়েছিল, সেসব স্থানে গিয়ে সরেজমিনে কাজ করে জাতিসংঘের দলটি।

প্রতিবেদন তৈরিতে অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী ব্যক্তিদের নিয়ে ২৩০টির বেশি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এ ছাড়া সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আরও ৩৬টি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এই ৩৬ জনের মধ্যে সরকারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারাও আছেন, যাঁরা ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত ছিলেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কোর কমিটিকে নিয়ে বৈঠকে নিয়মিতভাবে সভাপতিত্ব করতেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কোর কমিটির বৈঠকে সামগ্রিক পদক্ষেপের কৌশলগত নির্দেশনার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে বাহিনী মোতায়েন ও সুনির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অভিযান নিয়ে আলোচনা হতো। এর পাশাপাশি সমন্বিতভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমন্বয় প্রক্রিয়ার সম্পূরক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত ছিল। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এসবি, ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের প্রধানদের কাছে থেকে নিয়মিতভাবে সরাসরি প্রতিবেদন পেতেন। এ ধরনের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের মধ্যে ২১ জুলাইয়ের একটি প্রতিবেদনে আন্দোলনকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়ে শেখ হাসিনাকে সতর্ক করা হয়েছিল। একই ধরনের উদ্বেগ আগস্টের শুরুতেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হয়। ২৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আন্দোলন-সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেন। আর আন্দোলনের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টারা সরাসরি ও টেলিফোনে নিরাপত্তা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের আদেশ দিতেন ও সার্বিক অপারেশন পর্যবেক্ষণ করতেন।

যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জাতিসংঘের কাছে দাবি করেছেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইনের মধ্যে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে বলপ্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাহিনীগুলো নিজে থেকে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে। তবে এসব তথ্যের যথাযথ সত্যতা খুঁজে পায়নি জাতিসংঘ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ঢাকা শহরসহ সারা দেশে একই ধরনের সমন্বিত বল প্রয়োগ করেছে। সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক প্রতিবেদন মাঠ থেকে পেয়েছেন। তবে এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে শেখ হাসিনাসহ অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা তা গোপন করতে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি আন্দোলনকারী ও বিরোধী দলগুলোর ওপর দোষ চাপাতে মনোযোগী ছিলেন।

সাবেক ও বর্তমান কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যমতে, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগে সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছেন। ১৮ জুলাই কোর কমিটির বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) আন্দোলনকারীদের ওপর আরও মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন স্বাধীনভাবে পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা ও তথ্য সংগ্রহ করেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী পূর্ববর্তী সরকার, আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মাধ্যমে হাজারো আন্দোলনকারীকে গুরুতরভাবে আহত করে। নির্বিচার গ্রেপ্তার ও আটক রাখতে স্বেচ্ছাচারিতা, নির্যাতন এবং নানাভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত ছিল তারা। ওই সময় তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ছিল।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর সঙ্গে সমান্তরালভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। দুজনই নিয়মিত বিভিন্ন উৎস থেকে মাঠের চিত্র নিয়ে প্রতিবেদন পেতেন। মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়ে ২১ জুলাই ও আগস্টের শুরুতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল। এরপরও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিজিবি, র্যাব, ডিজিএফআই, পুলিশ, ডিবিকে বলপ্রয়োগের সরাসরি আদেশ ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সদস্য, যাঁরা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত বা জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সরকারের কোনো সত্যিকারের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পেছনে কোটা একমাত্র কারণ নয়। এ জন্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে সুশাসন নিয়ে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, কলুষিত রাজনৈতিক চর্চা, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার থেকে বঞ্চনার ক্ষোভের কথা বলা হয়েছে। ফলে ধর্ম ও পেশাজীবী মর্যাদানির্বিশেষে সত্যিকারের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে এ আন্দোলনে লাখো বাংলাদেশির মধ্যে নারী ও শিশুরাও অংশগ্রহণ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি হিসাবের পাশাপাশি অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়ে থাকতে পারেন। তাঁদের বেশির ভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যবহৃত মারণাস্ত্র ও শটগানের গুলিতে নিহত হয়েছেন। হাজারো মানুষ গুরুতর ও চিরতরে আহত হয়েছেন। ১১ হাজার ৭০০-এর বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব ও পুলিশ। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ শিশু। পুলিশসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ‘টার্গেট কিলিং’, ইচ্ছাকৃতভাবে পঙ্গু করা, নির্বিচার গ্রেপ্তার, অমানুষিক নির্যাতন ও নানাভাবে বল প্রয়োগ করেছে। আন্দোলনের শুরুতে নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সদস্যরা নারীদের ওপর হামলা করেছেন। এগুলো যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ছিল। এগুলোকে প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বলেছে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়েছে। সারা বিশ্বে আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠা আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পুলিশ গুলি করার সময় আবু সাঈদ যে নিরস্ত্র ছিলেন, প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করা হয়েছে।

জাতিসংঘের অনুসন্ধান দলটি জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত এবং সমস্যার মূল উৎস খুঁজে বের করতে ৫০টির মতো সুপারিশ করেছে। বলা হয়েছে, নিরপেক্ষভাবে কার্যকর, পক্ষপাতহীনতার সঙ্গে সব বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনার তদন্ত করতে হবে। র্যাব ও এনটিএমসিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশও করা হয়েছে। এনটিএমসিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্থাটি নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা খর্ব করেছে।

অন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাহিনীর কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ না থাকলে নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠানো; বিজিবি, ডিজিএফআইসহ গোয়েন্দা সংস্থার আইনি ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরা; আনসার, বিজিবিকে সামরিক বাহিনী থেকে মুক্ত রাখা; অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সামরিক বাহিনী অভ্যন্তরীণ যেকোনো পরিস্থিতিতে কতটা সময় কাজ করবে এবং মাঠে থাকবে, তা নিশ্চিত করা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে, এমন সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তদন্ত করা।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হলে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফেরার পথ রুদ্ধ হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক ভোটারকে ভোটাধিকার চর্চা থেকে বঞ্চিত করা হবে। প্রতিবেদনে অবাধ ও সত্যিকারের নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ভোটের আগে সব রাজনৈতিক দল যেন সমান প্রচারণার সুযোগ পায়। একই সঙ্গে নির্বাচনী প্রতিষ্ঠাগুলো যেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে, সে বিষয়ও নিশ্চিত করতে হবে।

ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জরুরিভিত্তিতে নিরাপত্তা ও বিচার বিভাগের সংস্কার করতে বলেছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশের আইনি কাঠামোর সংস্কারের পাশাপাশি স্বাধীন ও পক্ষপাতহীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া সর্বোচ্চ দণ্ড হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বাতিলের কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জুলাই-আগস্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন আরও স্বাধীন ও পক্ষপাতহীন তদন্তের পরামর্শ দিয়েছে। কিছু ঘটনা লোকমুখে শোনা বা পুরোপুরি তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহে ঘাটতি থাকায় তথ্যানুসন্ধান দল আবার ওই সব ঘটনার তদন্তের পরামর্শ দিয়েছে।

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ এখনো আগের মতো ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছে। এখনো গণহারে করা মামলায় ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হচ্ছে এবং ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ধর্মীয় ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত থাকায় ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবু প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এখনো দায়মুক্তি ভোগ করছেন।

জুলাই–আগস্টের ঘটনাপ্রবাহের মামলায় কয়েক হাজার মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে ১ হাজার ১৮১টি ঘটনার তদন্ত চলমান। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৯৮ হাজার ১৩৭। তাঁদের মধ্যে ২৫ হাজার ৩৩ জনের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। বিপুলসংখ্যক মানুষকে মামলায় আসামি করায় তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে অথবা গ্রেপ্তার করা হয়েছে; যদিও অনেকেরই এসব অপরাধের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততাই নেই। জাতিসংঘ বেশ কিছু মামলা পর্যালোচনা করে দেখেছে যে চিহ্নিত আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জনগণের চাপের মুখে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের উদ্বেগের বিষয়গুলো অন্তর্বর্তী সরকার আমলে নিয়ে সম্প্রতি কিছু সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সব উদ্বেগ আমলে নেওয়া হয়নি। এ আইনে মৃত্যুদণ্ড, আসামির অনুপস্থিতিতে বিচারের মতো বিষয়গুলোতে উদ্বেগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড বজায় রেখে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে কি না, তা নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই জুলাই ও আগস্টের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্তের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তদন্তের অনুরোধ জানিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ককে চিঠি লেখেন। এরপর টুর্ক একটি তথ্যানুসন্ধান দল গঠন করেন। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রুরি ম্যানগোভেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অগ্রবর্তী দল গত বছরের ২২ থেকে ২৯ আগস্ট ঢাকা সফর করে। এরপর তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘের মূল দল তথা তথ্যানুসন্ধান দল এক মাসের বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করে গত জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ ১৪ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করে।