Last Updated on 2 weeks by zajira news
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির কাছে সিরিয়া দেশটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে দেশটি এখন মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বহু শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রস্থল ছিল, যা আজও আছে।
সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ এবং দেশটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ঠিক করার প্রতিযোগিতা শুধু সিরিয়ার ভবিষ্যৎকেই নয়, বরং লেবানন, জর্ডান, ফিলিস্তিন, ইসরায়েল ও সিরিয়া তথা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করবে।
সিরিয়ার প্রতি সবার এত আগ্রহের কারণ হলো, এর অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ ও রাজনৈতিক গুরুত্ব। দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এটি দেশটিকে বিভিন্ন শক্তির কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। যার রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত সংযোগসহ।
বর্তমানে দেশটি পাঁচ দশকের স্বৈরশাসন ও ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত। কিন্তু তারপরও শত শত কূটনীতিক, ব্যবসায়ী, সমাজকর্মী ও বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী সেখানে উপস্থিত রয়েছে। কারণ, তারা বোঝে, সিরিয়ায় শক্তি ও ক্ষমতার যে পুনর্গঠন চলছে, তা শুধু দেশটির জন্যই নয়, পুরো অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
পাঁচ হাজার বছর ধরে সিরিয়ার জনগণ ও শাসকেরা তাঁদের বিষয়ে বহিরাগতদের আগ্রহের বিষয়টি অনুভব করে আসছেন। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে যখন দামেস্ক ও আলেপ্পো উন্নত, সমৃদ্ধ ও কৌশলগত শহর হিসেবে গড়ে ওঠে, তখন থেকেই সিরিয়া গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিহাসজুড়ে সিরিয়ার ভূমি ও জনগণ জ্ঞান, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, খাদ্য, প্রযুক্তি ও পরিচয়ের বিকাশ ঘটিয়েছে। এটি দেশটিকে বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে পরিণত করেছে।
সিরিয়ার ভেতরে দিয়ে স্থলপথে ভ্রমণ করলে দেখা যায়, একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রাস্তা, দুর্গ, খামার, পানি সরবরাহব্যবস্থা ও শহরগুলোর যোগাযোগব্যবস্থা। এই সবকিছু বহু বছর ধরে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাকে সংযুক্ত করা পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণ বাণিজ্য পথে সেবা দিয়ে আসছে।
এসব পথের ধারে আলেপ্পো, দামেস্ক, হোমস, হামা, দেইর আজ-জৌর, পালমিরা, দারা, লাতাকিয়াসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শহর গড়ে উঠেছে।
এই কৌশলগত শহরগুলোতে বহু জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করত। এদের মধ্যে সুন্নি, শিয়া, আলাওয়িত, দ্রুজ, খ্রিষ্টান, আর্মেনীয়, ইহুদি, আরব, কুর্দি আরও কিছু সম্প্রদায় রয়েছে। ইতিহাসজুড়ে কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে, কখনোবা অনানুষ্ঠানিকভাবে তারা এসব শহরে পারস্পরিক বিভেদ মিটিয়ে বসবাসের উপায় খুঁজে নিয়েছে।
সিরিয়া এমন একটি পূর্ণাঙ্গ আরব দেশ, যেখানে একটি সত্যিকারের রাষ্ট্র ও জাতির সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে রয়েছে উর্বর ভূমি ও পানিসম্পদ, খনিজ ও কৃষিজ সম্পদ, শিল্প খাত, দক্ষ নাগরিক, দক্ষ ব্যবস্থাপক ও উদ্যমী ব্যবসায়ী। পাশাপাশি, দেশটি ভূমি ও সমুদ্রপথে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বাণিজ্যপথ ও সম্পদের সঙ্গে সংযুক্ত।
প্রাচীন ও আধুনিক সাম্রাজ্য—গ্রিক, রোমান, পারস্য, বাইজেন্টাইন, ভারত, ব্রিটেন ও ফ্রান্স থেকে শুরু করে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত—সবাই সিরিয়াকে নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করেছে।
কারণ, এর ভেতর দিয়ে মহাদেশীয় বাণিজ্যপথ গেছে এবং দেশটির মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। যদি কেউ দামেস্কের শেরাটন হোটেলে কয়েক দিন কাটায় তাহলেই সে বুঝতে পারবে, এর বাস্তব উদাহরণ ।
প্রাচীনকাল থেকে ‘সিরিয়া’ বলতে আজকের সিরিয়া নয়, বরং বৃহত্তর সিরিয়া বা ‘বিলাদ-আশ-শাম’ বোঝানো হতো। এটি লেভান্ত অঞ্চলের একটি বিশাল অংশ এবং উর্বর ক্রিসেন্ট রিজনের (উর্ধ চন্দ্রাকৃতি ভূঅঞ্চল) বিশাল অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। এই অঞ্চলে বর্তমানের লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন এবং তুরস্ক ও ইরাকের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯২০ সালে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ সিরিয়ার ভবিষ্যৎকে বদলে দেয়। তখন সেখানে একটি সংবিধানভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্র গঠনের চেষ্টা চলছিল, যেখানে নির্বাচিত পার্লামেন্ট ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল। কিন্তু ফ্রান্স ও ব্রিটেন এই ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দেয়নি এবং তারা নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে সিরিয়ার ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। ফলে সিরিয়ার ঐক্য ও স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন ভেঙে যায় এবং পরবর্তী সময়ে যে রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি হয়, তা দুর্বল ও সংকটপূর্ণ হয়ে পড়ে।
সিরিয়ার ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, দেশটি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও কখনো পূর্ণ সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে পারেনি। সেখানে একের পর এক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত স্বৈরশাসন ও সামরিক শাসনে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও অর্থনীতিতে কিছু উন্নতি হলেও, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহির অভাবে তা শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়েছে। বৈচিত্র্যময় সমাজ বারবার সাম্প্রদায়িক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে।
সিরিয়ার বর্তমান নেতৃত্ব মূলত ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো থেকে উঠে এসেছে, যারা মার্কিন দখলকৃত ইরাকে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, তুরস্ক এবং অন্যান্য বিদেশি শক্তির সহায়তায় বাশার আল-আসাদের শাসন উৎখাত করেছে।
নতুন বাস্তবতায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বকে নিজেদের অনুকূলে রাখতে নানা উপায়ে চেষ্টা চালাবে। তারা ঘুষ, অস্ত্র এবং ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেবে, যাতে নতুন সিরিয়া তাদের স্বার্থের পক্ষে থাকে। যদি নতুন শাসকগোষ্ঠী এই চাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাহলে তারা নিশ্চিতভাবেই বিদেশি শক্তিগুলোর ষড়যন্ত্রের মুখে পড়বে। তবে তা মোকাবিলা করার শক্তিও সিরিয়ার মানুষের আছে। কারণ, তারা এর জন্য পাঁচ হাজার বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের ডিস্টিংগুইশড ফেলো।
রামি জি খৌরি আল–জাজিরা থেকে নেওয়া