সময়ের জনমাধ্যম

সায়েন্টিফিক রেভোল্যুশন ও পাশ্চাত্যের দার্শনিক চিন্তার বিবর্তন

Last Updated on 12 months by admin

মোহাম্মদ এন. হক, জৌষ্ঠ বার্তা সম্পাদক, জাজিরা নিউজ: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস, যা শুরু হয়েছিল বহু শতাব্দী আগে। তবে এর মূলগত পরিবর্তন ঘটে সায়েন্টিফিক রেভোল্যুশনের সময়, যখন পশ্চিমা বিশ্বে মানুষের চিন্তার জগতে এক বিপ্লব সূচিত হয়।

কিন্তু পশ্চিমা বিজ্ঞান ও দার্শনিক চিন্তার এ অগ্রযাত্রার মূলে শুধু ইউরোপের অবদান নয়, বরং এর গভীরে মিশে আছে ইসলামিক সভ্যতার অমূল্য অবদান। আজকের লেখায় সেই বিবর্তন, পরিবর্তন এবং ইসলাম ধর্মের অবদানকে আলোকপাত করবো।

পাশ্চাত্যের দার্শনিক চিন্তার বিবর্তন

পাশ্চাত্যের চিন্তার বিকাশ শুরু হয় গ্রিক দার্শনিকদের হাত ধরে, যেখানে অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস ও প্লেটো প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু যখন রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, তখন পশ্চিমা বিশ্ব জ্ঞানের অন্ধকার যুগে পতিত হয়। এই অন্ধকার যুগের মধ্যেও মুসলিম বিশ্বের বিদ্যাবুদ্ধির বিকাশ চলমান ছিল। ইসলাম ধর্মের সোনালী যুগে (৮ম থেকে ১৪শ শতাব্দী), মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা অনুবাদ করেন গ্রিক, পারস্য ও ভারতীয় বিজ্ঞান এবং দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলি।

ইবনে সিনা, আল-ফারাবি, আল-খাওয়ারিজমির মতো চিন্তাবিদেরা চিকিৎসা, গণিত, দর্শন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে যে বিপ্লবী চিন্তাভাবনা নিয়ে আসেন, তা পরে ইউরোপের রেনেসাঁকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে হাইথামের আলোকবিজ্ঞান বিষয়ে কাজ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। মুসলিম দার্শনিকরা বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে এক সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলেন, যেখানে আল্লাহর সৃষ্টিকে বোঝার একটি উপায় হিসেবে বিজ্ঞানের স্থান নির্ধারিত হয়।

সায়েন্টিফিক রেভোল্যুশন: চিন্তার বিপ্লব

১৬শ থেকে ১৭শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপে এক নব্যবিপ্লব শুরু হয়, যা পরিচিত সায়েন্টিফিক রেভোল্যুশন নামে। এর মূল শ্লোগান ছিল “নেচারকে জানতে হবে তার নিজস্ব নিয়মে”। নিকোলাস কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও গ্যালিলেই, এবং আইজ্যাক নিউটনের মতো বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর মহাবিশ্বে অবস্থান, গতির সূত্র এবং পদার্থের বৈশিষ্ট্য নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাদের কাজগুলো তখনকার প্রচলিত ধর্মীয় মতবাদগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, তবে বিজ্ঞান ধর্মের বিপক্ষে নয়, বরং এর অংশ বলেই মনে করেছিলেন অনেকেই।

এই রেভোল্যুশনের সাথে পাশ্চাত্যের দার্শনিক চিন্তাও নতুন রূপে বিকশিত হতে শুরু করে। রেনেসাঁস এবং রেফরমেশন মুভমেন্টের মাধ্যমে নতুন এক মানবতাবাদী চেতনার উদ্ভব হয়, যেখানে মানবজ্ঞান ও বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করা হয়। এই চিন্তার প্রেক্ষাপটে দেকার্তের মতো দার্শনিকগণ “Cogito, ergo sum” বা “আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি” মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।

ইসলাম ও পাশ্চাত্যের চিন্তার সংযোগ

বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই ব্যতিক্রমী ছিল। ইসলামের শুরু থেকেই বিজ্ঞানকে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেয়া হয়েছে। কুরআনের প্রথম নাযিলকৃত আয়াতেই বলা হয়েছে, “পড়ো, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন” (সূরা আলাক, ৯৬:১)। এই শিক্ষাটি বিজ্ঞান ও শিক্ষাকে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত পথ হিসেবে মূল্যায়ন করে। মুসলিম বিশ্বে এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত ছিল যে, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব এবং তারা আল্লাহর সৃষ্টি বুঝে সেটিকে উন্নত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত।

পাশ্চাত্যে সায়েন্টিফিক রেভোল্যুশন যখন নিজস্ব গতিতে চলতে শুরু করে, তখনও ইসলামের এই ভাবাদর্শের প্রভাব ছিল। যদিও ইউরোপের বিজ্ঞানীরা তখন ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছিলেন, ইসলামের বিজ্ঞানীরা সবসময় আল্লাহর সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনকে জ্ঞানের একটি মহৎ কাজ হিসেবে দেখেছেন। এখানেই বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে এক সামঞ্জস্যপূর্ণ সংযোগ তৈরি হয়, যা পাশ্চাত্যের দার্শনিক চিন্তায়ও প্রভাব ফেলেছে।

সমাপ্তি ভাবনা

সায়েন্টিফিক রেভোল্যুশনের ইতিহাস শুধুমাত্র ইউরোপের অর্জন নয়; বরং এটি বিভিন্ন সভ্যতার যৌথ প্রচেষ্টার ফল। ইসলামিক সভ্যতার অবদানকে অস্বীকার করা যায় না, যা আধুনিক বিজ্ঞান ও দার্শনিক চিন্তার অগ্রযাত্রার ভিত্তি রচনা করেছে। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে এক নতুন ভারসাম্যের সন্ধান করতে গেলে, আমরা দেখতে পাই যে ইসলাম বরাবরই বিজ্ঞানকে আল্লাহর সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের একটি পথ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
বিজ্ঞান এবং ধর্ম একে অপরের বিরোধী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক। মানুষের জ্ঞানের অগ্রগতি এবং আধ্যাত্মিকতার সমন্বয় করে আমরা একটি উন্নততর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারি।

Reendex

Must see news