সময়ের জনমাধ্যম

হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে মা মাছ, সংগ্রহের উৎসব

Last Updated on 4 weeks by zajira news

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি, জাজিরা নিউজ: দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ফের ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় মা মাছ। শত শত সংগ্রহকারী ডিম নিয়ে হালদা পাড়ে ছোটাছুটি করছে। সাথে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও গবেষকরাও।

শুক্রবার (৩০ মে) দুপুরে এ তথ্য জানান হাটহাজারী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার আনিসুল ইসলাম। তিনি জানান, মৌসুমের অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় বজ্রসহ বৃষ্টি হলে হালদা নদীতে যখন পাহাড়ি ঢল নামে তখন রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশ প্রজাতির মা মাছ ডিম ছাড়ে।

এবার সাগরে লঘুচাপের প্রভাবে বজ্রসহ বৃষ্টির পর বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ২টা থেকে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হলে হালদা নদীর বিভিন্ন অংশে ডিম ছাড়ে মা মাছ। এর আগে গত ২৭ মে মঙ্গলবার ভোর রাতে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের প্রভাবে হালদা নদীতে প্রথম দফায় নমুনা ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ।

তখন নদীর কিছু কিছু স্থানে স্বল্প পরিমাণে নিষিক্ত ডিম পাওয়া যায়। নদীতে পাহাড়ি ঢল না নামায় তখন পুরোদমে ডিম ছাড়েনি মা মাছ। সেই থেকে ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় জাল আর নৌকা নিয়ে হালদা পাড়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা।

ডিম সংগ্রহকারীরা জানান, বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ২টা থেকে হালদা নদীতে দ্বিতীয় দফা ডিম ছাড়ে মা মাছ। এ সময় যেমন বজ্রসহ বৃষ্টিপাত ছিল, তেমন প্রবল জোয়ার ছিল। এ সময় বৃষ্টি উপেক্ষা করে ডিম সংগ্রহের উৎসবে মেতে উঠেন সবাই।

হালদা পাড়ের নয়াহাটকুম এলাকার ডিম সংগ্রহকারী শহীদুল্লাহ ও কাটাখালী স্লুইসগেট এলাকার হাসান বলেন, শুক্রবার ভোর রাত ৪টা থেকেই আমরা নৌকা নিয়ে ডিম সংগ্রহ শুরু করি। হালদার মা মাছ এবার পুরোদমে ডিম ছেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। সবাই ডিম সংগ্রহে মেতে রয়েছে।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, হালদা নদীর হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা অংশে ডিম সংগ্রহের উৎসব চলছে। শত শত নৌকা নিয়ে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম আহরণ করছেন। নদীর দুই তীরে মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে।

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার রাত ২টা থেকে হালদা নদীর আমতুয়া অংশে ডিম ছেড়েছে মা মাছ। পরে ডিম হালদা নদীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। শ্বেত স্বর্ণের ডিম সংগ্রহ করতে পেরে ডিম সংগ্রহকারীদের মুখে হাসি ফুটেছে।

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, হালদা নদীর ২০ কিলোমিটার অংশজুড়ে ডিম সংগ্রহকারীরা নৌকা ও জাল নিয়ে নদীতে ডিম সংগ্রহ করছেন। হাজারো মানুষ ভিড় জমিয়েছেন। আমিও নদীতে আছি। নদীর পানি থেকে সরাসরি ডিম তুলে তা ভবিষ্যৎ মাছ চাষের জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

ড. মনজুরুল কিবরীয়া আরও বলেন, গত ২৭ মে মঙ্গলবার ভোর রাতের বৃষ্টি ও বজ্রপাতের প্রভাবে হালদা নদীর নাপিতের ঘাট থেকে নোয়াহাট পর্যন্ত কিছু অংশে নমুনা ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ। ওইদিন বিকেল পর্যন্ত কিছু কিছু স্থানে নিষিক্ত ডিম পাওয়া যায়। তবে নদীতে ঢল না নামায় পুরোদমে ডিম ছাড়েনি মা মাছ।

তিনি বলেন, গত ২৫ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত অমাবস্যার জো চলছে। এই সময়ের মধ্যে বজ্রবৃষ্টি ও ঢল নামলে মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়বে, এমন আশায় ছিলাম। ডিম সংগ্রহকারীরাও প্রস্তুতির পাশাপাশি আল্লাহর নিকট বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের জন্য প্রার্থনা করেছিল। অবশেষে কাঙ্খিত ডিম ছেড়েছে মা মাছ।

চট্টগ্রাম জেলা সিনিয়র সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জানান, হালদা নদীতে ৩৫০টি নৌকা ও ৪০০টি জাল নিয়ে ৬৫০ জন ডিম সংগ্রহ করছেন। পোনা তৈরিতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে অঙ্কুরীঘোনা মৎস্য বিভাগের ৬টি হ্যাচারি। মৎস্যজীবীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৬৮টি মাটির কুয়া তৈরি করেছেন। ডিম সংগ্রহের পর পোনা উৎপাদনের কাজ শুরু হয়ে যাবে।

মৎস্য কর্মকর্তা জানান, হালদার পোনা হ্যাচারি পোনার চেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল। ডিম সংগ্রহকারীরা হ্যাচারির কুয়া ও স্থানীয়ভাবে মাটির কুয়ায় রেণু ফুটিয়ে বাজারজাতের মাধ্যমে টাকা আয় করেন। রেণু বিক্রি ও মাছ চাষের মাধ্যমে পুরো বছর জীবিকা নির্বাহ করেন ডিম সংগ্রহকারীরা।

স্থানীয়রা মনে করেন, হালদার ডিম সংগ্রহ শুধু উৎসব নয়, এটি তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীবিকার অংশ। প্রতিবছর প্রাকৃতিকভাবে এই ডিম থেকে নতুন মাছের জন্ম হয়, যা দেশীয় মাছের উৎপাদন ও বৈচিত্র বাড়ায়। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রাকৃতিক মৎস্যবিজ্ঞানে এক দুর্লভ সম্পদ। তাই নদী রক্ষায় সতর্ক ও সচেতন তারা নিজেরাও।

হালদা রিসার্চ অ্যান্ড ল্যাবরেটরির তথ্যমতে, হালদা নদীতে গত ২০২৪ সালে ১ হাজার ৬৬০ কেজি মা-মাছের ডিম সংগ্রহ হয়। ২০২৩ সালে মা মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ হাজার কেজি। ২০২২ ও ২০২১ সালে ছিল এর চেয়ে কম। তবে ২০২০ সালে নদীতে ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল সাড়ে ২৫ হাজার কেজি। যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর নিষিক্ত ডিমের প্রতিকেজি রেণুর মূল্য দেড় লাখ টাকারও বেশি।

বর্তমানে নদীর পাড়ে স্থাপিত সরকারি ও ব্যক্তিগত হ্যাচারিগুলোতে রেণু উত্পাদনের কাজ চলছে পুরোদমে। সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, নৌ পুলিশ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ডিম সংগ্রহ ও পরিবেশ মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে।

Reendex

Must see news