Last Updated on 1 year by zajira news
নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে পাওয়া দেশি-বিদেশি ঋণের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পদত্যাগের সময় শেখ হাসিনার সরকার ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ রেখে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ ঋণ পরিশোধে এখন ব্যবস্থা নিতে হবে।
সদ্য ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছরের বেশি সময়ে দেদার ঋণ নিয়েছে। এ ঋণের বড় অংশই নেওয়া হয়েছে দেশি উৎস থেকে। এর মধ্যে আবার বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে।
বিশ্লেষকদের মতে, সাবেক সরকারের যথাযথ ঋণ ব্যবস্থাপনা না থাকায় দেশি উৎস থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নেওয়া হয়েছে। যদিও বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশি ঋণ নেওয়াকে সব সময় স্বাগত জানান অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। গত ১৫ বছরে অনেক বিদেশি ঋণও নেওয়া হয়েছে। তবে এসব ঋণের বেশির ভাগই নেওয়া হয়েছে দর–কষাকষি ও বাছবিচারহীনভাবে; যা সরকারের দায়দেনা পরিস্থিতিতে চাপ বাড়িয়েছে।
সামনে আসছে ঋণ পরিশোধের চাপ। এত অপরিকল্পিত ও প্রায় দর-কষাকষিহীনভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নেওয়া হয়েছে, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে।
অর্থ বিভাগ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ঋণের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। তাতে মোট ঋণের স্থিতি দেখানো হয়েছে ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ঋণের হিসাব হালনাগাদ করা হয় তিন মাস পরপর। মার্চ ও জুনের হিসাব আরও কিছুদিন পর তৈরি করা হবে। অর্থ বিভাগ ধারণা করছে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশি-বিদেশি ঋণ স্থিতি দাঁড়াবে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে দেশি অংশ হবে ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা আর বিদেশি অংশ ৮ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, জুন মাস শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭৯০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ১১৮ টাকা দরে হিসাব করলে তা ৮ লাখ ১ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। গত ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৫ হাজার ৫২০ কোটি টাকা।
এসব ঋণ সরকারি ও সার্বভৌম নিরাপত্তাপ্রাপ্ত ঋণ হিসেবে পরিচিত। ঋণ নেওয়া, ঋণের সুদ দেওয়া, আসল পরিশোধ করা, আবার ঋণ নেওয়া—বিষয়টি এভাবে চলতে থাকে। স্থিতি হিসেবে উল্লেখ থাকা অর্থ ভবিষ্যতে পরিশোধযোগ্য। ডিসেম্বর শেষে ৯ লাখ ৫৩ হাজার ৮১৪ কোটি টাকার দেশি ঋণের মধ্যে শুধু ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া ঋণের স্থিতিই ছিল ৫ লাখ ২৫ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। বাকি ঋণ নেওয়া হয়েছে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিপরীতে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র ও সাধারণ ভবিষ্য তহবিলের বিপরীতেও আছে বড় অঙ্কের ঋণ।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি যখন সরকারের দায়িত্ব নেয়, তখন দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। ওই সময় দেশি ঋণের চেয়ে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেশি ছিল। কিন্তু মাত্রই বিদায় নেওয়া সরকারের শেষ দিকে এসে তা উল্টে যায়। এ সময়ে অবশ্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকারও বাড়ে।
অর্থ বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরেও দেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। ক্ষমতায় তখন আওয়ামী লীগই ছিল। কিন্তু ছয় বছরের ব্যবধানে এ ঋণ বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়।
ডিসেম্বর শেষে ৯ লাখ ৫৩ হাজার ৮১৪ কোটি টাকার দেশি ঋণের মধ্যে শুধু ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া ঋণের স্থিতিই ছিল ৫ লাখ ২৫ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। বাকি ঋণ নেওয়া হয়েছে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিপরীতে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র ও সাধারণ ভবিষ্য তহবিলের বিপরীতেও আছে বড় অঙ্কের ঋণ।
বিপুল ঋণ নেওয়ার কারণে আসল ও সুদ পরিশোধের চাপ এখন বর্তমান সরকারের ঘাড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে সুদের হারও অনেক বেড়েছে। দুই বছর আগেও সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার ছিল ১ থেকে ৬ শতাংশ। বর্তমানে গড় সুদহার ১২ শতাংশ। সঞ্চয়পত্র নতুন করে বিক্রি হচ্ছে কম। তবে এর বিপরীতে আগে নেওয়া ঋণের সুদ দিতে হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে দেশি ঋণের সুদই ৯৩ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি, তা ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের মধ্যে একটি উৎস হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, আরেকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের অর্থই হচ্ছে টাকা ছাপানো। এতে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়, যা উসকে দেয় মূল্যস্ফীতিকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি, তা ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশের ভেতর ও বিদেশ উভয় উৎস থেকেই ঋণ নিয়ে থাকে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদেশি ঋণ সস্তা, সুদ গুনতে হয় কম এবং পরিশোধের লম্বা সময় পাওয়া যায়। কিন্তু বিদেশি ঋণ পেতে হলে একদিকে দর-কষাকষি করার সক্ষমতা থাকতে হয়, অন্যদিকে মানতে হয় নিয়মনীতি। সেই তুলনায় দেশি ঋণ চাইলেই পাওয়া যায়। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতকে আমলে না নিয়ে আওয়ামী সরকার এত বছর বেশি নির্ভরশীল থেকেছে দেশি ঋণের ওপরই।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশি ও বিদেশি দুই ধরনের ঋণের প্রতিই ঝুঁকেছিল আগের সরকার। শেষ ছয়-সাত বছরে দ্রুত হারে উভয় ধরনের ঋণ নেওয়া বেড়েছে এবং বেশি বেড়েছে দেশি ঋণ। তার কারণও ছিল। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা ছিল জিডিপির তুলনায় কর সংগ্রহকে ১৪ শতাংশে নিয়ে যাওয়া; কিন্তু তা হয়নি, উল্টো এই অনুপাত ১১ শতাংশ থেকে তা ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে কর দেওয়ার জন্য সামর্থ্যবান লোকদের কাছে সরকার পৌঁছাতে পারেনি বা চায়নি। আর এটাই হচ্ছে আদি পাপ। কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে এত ঋণ নিতেই হতো না।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করেছি বলে আমরা বড় গলায় কথা বলি। তা–ও তো করা হয়েছে ঋণ নিয়েই। সামনে আসছে ঋণ পরিশোধের চাপ। এত অপরিকল্পিত ও প্রায় দর-কষাকষিহীনভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নেওয়া হয়েছে, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে। দুই বছর পর থেকেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সুদ দেওয়া শুরু করতে হবে।’
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ১৫ বছরে বিদেশি ঋণের বোঝা বেড়েছে তিন গুণের বেশি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৮৫ কোটি ডলার। আওয়ামী লীগ সরকার কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পাশাপাশি রেল ও বিদ্যুৎ খাতে ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে কঠিন শর্তের ঋণও নেয়।
সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে অর্থাৎ গত জুন মাস শেষে সরকারের পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৭৯০ কোটি ডলারে। সে হিসাবে বর্তমানে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মাথার ওপর গড়ে ৪০০ ডলারের মতো বিদেশি ঋণের বোঝা রয়েছে।
পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করেছি বলে আমরা বড় গলায় কথা বলি। তা–ও তো করা হয়েছে ঋণ নিয়েই। সামনে আসছে ঋণ পরিশোধের চাপ। এত অপরিকল্পিত ও প্রায় দর-কষাকষিহীনভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নেওয়া হয়েছে, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে। দুই বছর পর থেকেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সুদ দেওয়া শুরু করতে হবে।
দেশের অবকাঠামো খাতে উন্নয়নের কথা বললেও বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে কয়েক বছর ধরেই চাপে ছিল আওয়ামী লীগের সরকার। এ চাপ শুরু হয় এমন সময়ে, যখন দেশে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে রিজার্ভের পাশাপাশি বাজেটেও বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে রেকর্ড প্রায় ৩৩৬ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। এর মধ্যে আসল ২০১ কোটি ডলার ও সুদ প্রায় ১৩৫ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুদ ও আসল মিলিয়ে ২৬৮ কোটি ডলার পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। অথচ এর ঠিক এক দশক আগে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ।
অর্থ উপদেষ্টা ওই দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশকে অর্থ দিতে সবাই আগ্রহী। ইআরডি কর্মকর্তাদের বলেছি যে তা যেন যাচাই–বাছাই করে নেওয়া হয়। কারণ, ঢালাও ঋণ নিয়ে আফ্রিকার অনেক দেশের করুণ পরিণতি আমরা দেখেছি।’
সূত্রগুলো জানায়, প্রতিবছর যত বিদেশি ঋণ পায় সরকার, তার এক-তৃতীয়াংশ অর্থই চলে যায় ঋণের সুদ ও আসল শোধ করতে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি বিদেশি ঋণ শোধ করতে হয়েছে।
রূপপুর প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৬ সালে। এ সময় আরও দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার জন্য দেনদরবার চলছে। বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের ঋণের কিস্তি কমানোর আলোচনাও চলমান। প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণ চীনা মুদ্রায় নেওয়ার উদ্যোগেও ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বন করছে ঢাকা। এ ঋণ নিয়ে আলোচনা করতে চলতি মাসেই চীনের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসার কথা ছিল। তবে এখন তা অনিশ্চিত।
নতুন সরকার দায়িত্বে এসে অবশ্য বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। এ নিয়ে গত বুধবার ইআরডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠকে তিনি বিদেশি ঋণ নেওয়ার সময় সুদের হার, কিস্তি, পরিশোধের মেয়াদসহ বিভিন্ন শর্ত যাচাই–বাছাই করার নির্দেশ দেন। সূত্র, প্রথম আলো