সময়ের জনমাধ্যম

৩০ হাজার টাকায় রোহিঙ্গারা যেভাবে হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিক

ছবিতে ৫ প্রতারক চক্র (ইনসেটে রোহিঙ্গাদের ফাইল ফটো)

Last Updated on 2 years by admin

নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজঃ সাধারণত দেশের জনসাধারণ সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন করে থাকে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পৌরসভার মেয়র, পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদ সচিব তাদের নির্দিষ্ট আইডির মাধ্যমে কাজটি করে দেন। পরে সেগুলো সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে দেখতে পান নিবন্ধনকারী। এক্ষেত্রে ঝামেলা এড়াতে পৌরসভা কিংবা ইউনিয়নের কম্পিউটার অপারেটরদের কাছে নিজেদের আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখেন মেয়র, চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ বানিয়ে দেয়া একটি চক্রের পাঁচ সদস্যকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার বিভাগ। একটি জন্মনিবন্ধন সনদ বানিয়ে দিতে চক্রের সদস্যরা ৩০-৫০ হাজার টাকা নিতেন। মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট ও দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন মো. শহিদুল ইসলাম, রাসেল খান, মোস্তাফিজুর রহমান, আবদুর রশিদ ও সোহেল চন্দ্র।

ডিবি জানায়, মেয়র, চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের সচিবদের আইডি ব্যবহার করে হাজার-হাজার রোহিঙ্গার ভুয়া জন্মনিবন্ধন বানিয়ে দিয়েছেন এই চক্রের সদস্যরা। এভাবে রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হচ্ছেন।

গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের মধ্যে ২ জন কম্পিউটার অপারেটর, ১ জন স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে এবং বাকি ২ জন পড়াশোনা করে। কিন্তু তারা রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরিতে অধিক লাভ দেখে তারা এই অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। আর রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব না থাকাতে তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাই অনেক রোহিঙ্গারা লাভবান হওয়ার জন্য জন্মনিবন্ধন তৈরি করেছে। এতে করে গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত আসামি মো. আব্দুর রশিদ দিনাজপুর বিরল পৌরসভার এবং সোহেল চন্দ্র বিরলের ১০নং রাণীপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কর্মরত। রশিদ বিরল পৌরসভার মেয়র সবুজার সিদ্দিক সাগর ও পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা হরানন্দ রায় এবং সোহেল চন্দ্র রাণীপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আল্লামা আজাদ ইকবাল ও ইউনিয়ন সচিব মোহাম্মদ মানিক হোসেনের জন্মনিবন্ধন সার্ভারের একসেস ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন সনদ ও নম্বর দিয়ে আসছিল। আর তাদেরকে জন্মনিবন্ধন তৈরি করে দেয়ার কাজ এনে দিতো মো. মোস্তাফিজুর রহমান।

গ্রেপ্তারকৃত মো. শহিদুল ইসলাম মুন্না এবং মো. রাসেল খানও তাদের জন্মনিবন্ধন তৈরি করার কাজ এনে দিতো। তারা দু’জন বাগেরহাট ও নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা। গ্রেপ্তারকৃত সবাই আগে থেকেই একে অপরের পরিচিত এবং একই ধরনের কাজ দীর্ঘদিন ধরে করছিল। তারা রোহিঙ্গাদের বিরল পৌরসভার বাসিন্দা দেখিয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করে দিতো। অবৈধভাবে এসব কাজ করে যে লাভ হতো সেগুলো তারা ভাগাভাগি করে নিতো। কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়নে তাদের সহযোগীরা রয়েছে। অবৈধ এসব কাজ তারা যেকোনো পৌরসভা ও ইউনিয়ন থেকে করিয়ে নিতো।

ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (দক্ষিণ) অর্গানাইজড অ্যান্ড ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুর রহমান আজাদ মানবজমিনকে বলেন, টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে তৈরি করা এসব জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের নাগরিক হয়েছে। দাগি, কুখ্যাত খুনি, ডাকাত এবং রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধীরা এলাকার বাহিরে আরেকটি জন্মনিবন্ধন করে অপরাধ করে বেড়াচ্ছে।

এসব জন্মনিবন্ধন নিয়ে পাসপোর্টও তৈরি করে তারা বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংক লোন নিচ্ছে। এমনকি অনলাইন অপরাধে পুলিশকে ফাঁকি দিচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো ব্যবহারকারীরা আইডি পাসওয়ার্ড তাদের অধস্তনদের কাছে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। শক্তিশালী আইটি সলিউশন টিম ও ইক্যুপমেন্ট ব্যবহার করতে হবে। এনআইডি, জন্মনিবন্ধন সার্ভারসহ গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোতে দুর্বলতা থাকলে জরুরিভাবে সমাধানে যেতে হবে। এ ছাড়া নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষের মনিটরিং জোরদার করতে হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কক্সবাজার এলাকার রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে জন্মনিবন্ধন সংগ্রহ করে এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরি করেছে। তাদেরকে সহায়তা করছে পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবের কম্পিউটার অপারেটররা। এসব অভিযোগে আমরা পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে চাকরি করার সুবাদে তাদের কাছে প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তাদের সার্ভারের আইডি পাসওয়ার্ড থাকতো। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জন্মনিবন্ধন তৈরি করে দিতো।

হারুন বলেন, আমরা আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। যাদের ধরেছি তারাও এসবের সঙ্গে জড়িত। প্রায়ই তারা মানুষকে অবৈধভাবে জন্মনিবন্ধন করে দেয়। এসবের সঙ্গে পাসপোর্ট, নির্বাচন কমিশন, পুলিশের কেউ জড়িত আছে কিনা আমরা খতিয়ে দেখবো। কারণ কীভাবে তারা কাদেরকে দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে সেটি জানার চেষ্টা করবো।