Last Updated on 11 months by zajira news
নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবির আন্দোলন ও পরবর্তী সহিংসতায় ৪ থেকে ৬ আগস্ট এই তিন দিনেই অন্তত ৩২৬ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থক, বিএনপির নেতা-কর্মী, পুলিশের সদস্য ও শিক্ষার্থীরা বেশি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট (সোমবার) শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। তিনি এখন ভারতে রয়েছেন। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই তিন দিনে পুলিশের গুলিতে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আবার পুলিশকেও মারধর করে হত্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হামলা ও গুলিতে বিক্ষোভকারীদের মৃত্যু হয়েছে। আবার বিক্ষোভকারী ও প্রতিপক্ষের হামলা এবং অগ্নিসংযোগে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
সব মিলিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন, পরবর্তী বিক্ষোভ ও সরকারের পতনের পর সহিংসতায় ১৬ জুলাই থেকে গতকাল রোববার (১১ আগস্ট) পর্যন্ত অন্তত ৫৮০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ২১৭ জন নিহতের খবর পাওয়া গিয়েছিল। ৩২৬ জন নিহত হন ৪ থেকে ৬ আগস্টের (রবি থেকে মঙ্গলবার) মধ্যে। বাকি ৩৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় ৭ থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে।
৭-১১ আগস্ট সময়ে কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বেশির ভাগের মরদেহ পরে হাসপাতালে আনা হয়। কখন মৃত্যু হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।বিক্ষোভকারী ও প্রতিপক্ষের হামলা এবং অগ্নিসংযোগে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৪ থেকে ৬ আগস্ট (রবি থেকে মঙ্গলবার) সময়ে নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ দলটির নেতা, কর্মী ও সমর্থক রয়েছেন অন্তত ৮৭ জন। পুলিশ সদস্য রয়েছেন ৩৬ জন। বিজিবি, র্যাব ও আনসার সদস্য রয়েছেন একজন করে।
১৬ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৪২ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন বলে গতকাল রোববার জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল ইসলাম। তিনি জানান, ৪২ জনের মধ্যে দুজন পুলিশ সদস্য র্যাবে নিয়োজিত ছিলেন।
৪ থেকে ৬ আগস্ট সময়ে নিহতদের মধ্যে অন্তত ২৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পড়তেন। এ সময়ে নিহতদের মধ্যে বিএনপি ও দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ১২ জন নেতা, কর্মী ও সমর্থক রয়েছেন।
৩২৬ জনের মধ্যে বাকি ১৬৮ জনের সরাসরি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই অথবা জানা যায়নি। ৪২ জনের পরিচয়ই এখনো নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। আহত হয়েছেন বহু মানুষ।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল রাজধানীর রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ ও অন্যদের গুলিতে অনেক মানুষ মারা গেছেন। পুলিশের ওপরও ব্যাপক হামলা হয়েছে। তিনি বলেন, পুলিশকে যারা ব্যবহার করেছে, তাদের বিচার হবে। হুকুমদাতাদের কঠোর শাস্তি হবে।
৩ আগস্ট (শনিবার) ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজার হাজার মানুষের জমায়েতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করে। ৪ আগস্ট (রোববার) থেকে ছিল তাদের সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নেয় যে ৪ আগস্ট তারা দলের নেতা-কর্মীদের মাঠে নামিয়ে দেবে। ওই দিন ঢাকার ওয়ার্ড এবং জেলায় জেলায় তাদের জমায়েত কর্মসূচি ছিল।
৪ আগস্ট দেখা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। যদিও প্রতিরোধের মুখে তাঁরা বেশি সময় রাস্তায় টিকতে পারেননি। ওই দিন পুলিশকে আগের মতো সক্রিয় দেখা যায়নি। যদিও কিছু জায়গায় বিক্ষোভ দমনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ছিল পুলিশ। সেদিন গুলিতে বিক্ষোভকারীরা নিহত হয়েছেন। আবার মাঠছাড়া হওয়ার পর বিক্ষোভকারীদের হামলায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও নিহত হয়েছেন। এদিন (৪ আগস্ট) সারা দেশে অন্তত ১১১ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়। যার মধ্যে ২৭ জন আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থক। এর মধ্যে নরসিংদীর মাধবদীতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মিছিল থেকে গুলি করা হয়। পরে আওয়ামী লীগের ৬ নেতা-কর্মীকে মারধর করে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে চরদিঘলদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনও রয়েছেন।
যদিও কিছু জায়গায় বিক্ষোভ দমনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ছিল পুলিশ। সেদিন গুলিতে বিক্ষোভকারীরা নিহত হয়েছেন। আবার মাঠছাড়া হওয়ার পর বিক্ষোভকারীদের হামলায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও নিহত হয়েছেন।
৫ আগস্ট (সোমবার) দুপুরের দিকে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর অনেক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর ওপর ও তাঁদের বাড়িতে হামলা হয়, আগুন দেওয়া হয়। পরদিনও সহিংসতা হয়। এতে অনেকে নিহত হন। ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকির হোসেনের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ওই দিন জাকিরের করা গুলিতে হামলাকারী দুজন নিহত হন। পরে হামলাকারীরা জাকির, তাঁর ভাই জাহাঙ্গীরসহ ছয়জনকে মারধর করে হত্যা করে।
মেঘনা নদীর বালু দস্যুতার অভিযোগ থাকা চাঁদপুরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খান ও তাঁর ছেলে শান্ত খানকে ৫ আগস্ট মারধর করে হত্যা করা হয়। বরিশালের সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হলে তিনজনের মৃত্যু হয়। পরে জানা যায়, তাঁদের দুজন যুবলীগের কর্মী।
৫ আগস্ট মোট ১০৮ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪৯ জন। ৬ আগস্ট (মঙ্গলবার) মোট নিহত হন ১০৭ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ১১ জন।
৬ আগস্টের মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিহত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অনেকের বিরুদ্ধে নিজ এলাকায় ‘বাড়াবাড়ি’ করা ও প্রতিপক্ষের ওপর হামলার অভিযোগ ছিল। কারও কারও বিরুদ্ধে ছিল সন্ত্রাস, দখল, নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ। কাউকে কাউকে খুন করা হয়েছে প্রতিশোধ নিতে। ওই দিন অবশ্য যাত্রাবাড়ী থেকে আরও ৩১ জনের মরদেহ আসে। তাঁদের মৃত্যু হয়েছিল গুলিতে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ৫ আগস্ট (সোমবার) শেখ হাসিনার পদত্যাগের দিন যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছাত্র-জনতা ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা গুলি করে মানুষ হত্যার অভিযোগ তুলে পুলিশের ওপর হামলার চেষ্টা চালায়। পুলিশও নির্বিচার গুলি ছোড়ে। এতে অনেক বিক্ষোভকারী নিহত হন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ আর রক্ষা পায়নি। থানায় হামলা হয়। পুলিশ সদস্যদের মারধর করে হত্যা করা হয় এবং থানায় আগুন দেওয়া হয়।
ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে ব্যাপক হতাহতের ঘটনার পর পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার ও কিছু কর্মকর্তার উচ্চাভিলাষের কারণে সাধারণ পুলিশ সদস্যদের প্রাণ দিতে হয়েছে।
এর আগে জুলাই মাসে নিহত ২১২ জনের মধ্যে ১৭৫ জনের মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৭৮ শতাংশের শরীরে প্রাণঘাতী গুলির (বুলেট) ক্ষতচিহ্ন ছিল। নিহতের (১৭৫) মধ্যে ৪৬ জন ছিলেন শিক্ষার্থী। সরাসরি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গিয়েছিল ছয়জনের। তাঁদের মধ্যে তিনজন আওয়ামী লীগের, দুজন বিএনপির ও একজন ছাত্রশিবিরের। পুলিশ সদস্য ছিলেন তিনজন, একজন ছিলেন আনসার সদস্য। বাকিরা বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল ছাড়া কখনো সংঘর্ষ ও সহিংসতায় এত মানুষের মৃত্যু ঘটেনি। এবার এত মানুষ মারা যাওয়ার কারণ পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার, নাগরিকদের হত্যা করে হলেও ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনাগ্রহ। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল ছাড়া কখনো সংঘর্ষ ও সহিংসতায় এত মানুষের মৃত্যু ঘটেনি। এবার এত মানুষ মারা যাওয়ার কারণ পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার, নাগরিকদের হত্যা করে হলেও ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনাগ্রহ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভ দমনে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে মারমুখী অবস্থানে ছিল। হতাহতের বড় কারণ এটা। বিক্ষোভ দমনে সরকারি দলও মাঠে নেমেছিল। তারা ব্যর্থ হয়েছে এবং পরে ক্ষোভের কারণে হামলার শিকার হয়েছে। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের কারণে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।