সময়ের জনমাধ্যম

নেই ইন্টারনেট, সহিংসতা ও কারফিউর কারণে ভোগান্তিতে মানুষ

কারফিউ চলাকালীন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের (বামে) মুখে রাস্তায় বের হওয়া মানুষ। (ডানে) সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা

Last Updated on 11 months by zajira news

নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: কয়েকদিন ইন্টারনেট না থাকায় মোবাইল ব্যাংকিং অচল হয়ে পড়ার কারণে বিপাকে পড়েছে বিদ্যুতের হাজার হাজার প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী। রবিবার (২১ জুলাই) ডেসকো অফিসের সামনে ভিড় করেছে শত শত মানুষ।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনের জের ধরে টানা কয়েকদিনের সহিংসতা এবং এরপর দু’দিনের কারফিউতে রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে জনজীবনে নানা ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, যার ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে অসংখ্য মানুষ।

বড় ছোট বাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ কমে আসার কারণে দাম বেড়ে যাওয়া, শহরজুড়ে ঔষধের যোগান কমে আসার পাশাপাশি পরিবহন বন্ধ থাকার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে।

ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও অনেক জায়গায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের, বিশেষ করে মাছ -মাংস- তরিতরকারি ও জরুরি দরকারি দ্রব্যের যোগান কমে আসায় কারফিউ শিথিলের সময়ে লোকজন চাহিদা অনুযায়ী এসব দ্রব্য পাচ্ছে না।

রবিবার বিকেলে কারফিউ শিথিল হয়েছিলো দু’ঘণ্টার জন্য। ওই সময়েই প্রিপেইড মিটারের কার্ড রিচার্জ করার জন্য ডেসকোর জোনাল অফিসের সামনে এসেছিলেন মিঠুন নামের একজন গ্রাহক।দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় তিনি বলছিলেন, “কোথাও কার্ড রিচার্জ করতে পারিনি। লাইন বন্ধ হয়ে গেলে বিপদে পড়বো, বিদ্যুৎহীন থাকতে হবে। ডেসকোতে এসেও দীর্ঘ লাইনে পড়লাম।”

সেসময় ওই লাইনে ছিলেন শত শত মানুষ। ইন্টারনেট না থাকায় মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধ থাকার কারণে তারা গত কয়েকদিন কার্ড রিচার্জ করতে পারেননি। তাই অনেকেরই প্রিপেইড মিটারের ব্যালেন্স ফুরিয়ে গেছে।

ওই লাইনে থাকা আরেকজন গ্রাহক বলেছেন তিনি চারবার ডেসকোতে আসলেও তার সমস্যার সমাধান হয়নি।‘’এখন কার্ড জমা রেখে সোমবার সকালে আমাকে আবার যেতে বলেছে,” বলেন তিনি।সমস্যা এতো প্রকট হয়েছে যে রবিবার বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে- প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ সমস্যা দূর করতে ‘লোন’ এর পরিমাণ সিঙ্গেল ফেজ-এ এক হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার এবং ফ্রি ফেজ-এ দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে পাঁচ হাজার করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এর ফলে প্রিপেইড মিটারের ব্যালেন্স ফুরিয়ে গেলেও তাদের লাইন কাটা যাবে না এবং বাড়তি টাকা তারা পরে বিলের সাথে সমন্বয় করতে পারবেন।

কারওয়ান বাজারের এক মুরগী ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে বিক্রেতারা আছে, কিন্তু ক্রেতা খুবই কম। এমনকি বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট দোকানিরা যে পাইকারি দামে মালামাল নিতে আসে তাদের সংখ্যাও ছিলো খুব কম।“এলাকাভিত্তিক কিছু লোক এসে মুরগী কিনেছে। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় খুবই কম। যদিও দাম কিন্তু বাড়েনি তেমন একটা,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

রমনা এলাকার ক্ষুদ্র দোকানি কুদ্দুস মিয়া প্রতিদিন সকালে কারওয়ান বাজার থেকে শাক সবজি তরিতরকারি কিনে এনে বিক্রি করেন তিনি।“আজ রবিবার সকালে কারওয়ান বাজারে গিয়ে কিছু পাই নাই। পটলের দাম কাল ছিলো ২৮-৩০ টাকা, আর আজ দেখলাম ৬০ টাকা। চিচিঙ্গাসহ সব তরকারির দামই এমন। আমি কিছু না নিয়ে ফিরে এসেছি, বলছিলেন তিনি।

রামপুরা-বাড্ডা এলাকার দোকানি জামিলবলেছেন কাঁচামরিচ, বেগুন, ডিম, টমেটোসহ সবকিছুর দাম অনেক বেড়ে গেছে। “কাঁচামরিচের পাল্লা (প্রতি পাল্লায় পাঁচ কেজি) ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। গত কয়েকদিনে সব জিনিসের দাম বেড়েছে। কিছু মাল মার্কেটেই নাই। খুচরা বাজারে ২০-৩০ টাকা করে বেড়েছে গত দুই একদিনে,” বলছিলেন তিনি।

ওই এলাকায় কোন দোকানে ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছিলো ১৮০ টাকা। আবার কোথাও দেখা গেছে ২২০ টাকা করে দাম চাইতে। পাইকারিতে টমেটোর কেজি ১৬০ টাকা ছিলো দুদিন আগেও, রবিবার সেটি ২০০ টাকা চেয়েছেন পাইকারি বিক্রেতারা।

ঢাকার বাজারগুলোতে যেসব এলাকা থেকে সবজি আসে তার একটি হলো যশোর। সেখানকার সবজি চাষি ও ব্যবসায়ী মানিক মিয়া জানান- স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় তিন ভাগের একভাগেরও কম সবজি যাচ্ছে না ঢাকায়।

“গত দুদিনে মাল পাঠানোর জন্য গাড়ি পাওয়া যায়নি। সবজির গাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে মাল পাঠানো যাচ্ছে না,” বলছিলেন তিনি।

নরসিংদীতে সহিংসতার কারণে সেখানকার সবজিও ঢাকায় আসা কমেছে গত দুদিনে। এর ফলে এলাকাভিত্তিক দোকানগুলোতে শাক সবজির স্বল্পতার পাশাপাশি আলু, আদা, রসুনের মতো দ্রব্যও কম পাওয়া যাচ্ছে।

যশোর-বেনাপোল সড়কে দূরপাল্লার পরিবহন কম থাকলেও, স্থানীয়ভাবে যানবাহন কম হলেও চলছে বলে জানান তিনি।

উত্তরাঞ্চলীয় শহর রংপুরের প্রতিনিধি জানান শহরে লোক চলাচল খুবই কম ছিলো রবিবার। “জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। পণ্যবাহী ট্রাকগুলো আসতে পারছে না।

বরিশালের এক প্রতিনিধি বলেন শহরের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ কমতে শুরু করেছে বলে মনে হয়েছে তার কাছে।“কারফিউ শিথিল হলে মানুষ খুব দরকারি ছাড়া অন্য কিছু কিনতে পারছে না। আবার কাঁচাবাজারে সরবরাহও কম দেখা যাচ্ছে,” বলছিলেন তিনি।

উত্তর বাড্ডায় ইবনে সিনা হাসপাতালের পেছনে এক ঔষধ ব্যবসায়ী জাকির জানান যে কিছু কিছু ঔষধের সরবরাহ কমে গেছে এবং এর কারণ হলো ওই এলাকায় ঔষধ বহন করা গাড়ি আসতে না পারা।কারফিউর সময় ঔষধের দোকান খোলা রাখার অনুমতি থাকলেও ঢাকার বহু এলাকায় ফার্মেসিগুলো বন্ধ দেখা গেছে। রবিবার দুপুরে গুলশানের এক নম্বর সার্কেলে কোনো ফার্মেসি খোলা পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঔষধ শিল্প সমিতির একজন নেতা বলেন মূলত, সহিংসতার কারণে দোকানগুলো খোলা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন।“এই যে গুলশান-১ এর দোকানগুলো বন্ধ দেখছেন এর যৌক্তিক কারণ আছে। ওখানে দেখেন, এখনো একটা ফার্মেসির সামনে পুড়ে যাওয়া গাড়ি পড়ে আছে। এসব কারণেই সেখানকার ফার্মেসিগুলো বন্ধ। আর যানবাহন বন্ধ এবং কারফিউর কারণে চলাচলে বিধিনিষেধ আছে। সেজন্য অনেক জায়গায় সাপ্লাই কমেছে বলে জানান তিনি।

“হাসপাতাল এলাকায় ঔষধের দোকান ছাড়াও এলাকার খাবারের দোকানগুলো চালু আছে। এমনি লোকজন কম বের হচ্ছে। কিন্তু এখানে প্রভাবটা কম পড়েছে,বলছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার শুক্রবার মধ্য রাত থেকেই কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দেয়ায় জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে পরিবহন বন্ধ থাকায় কাঁচাবাজারে সরবরাহ কমে এসেছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছে অসংখ্য মানুষ।