সময়ের জনমাধ্যম

ভারতের মনিপুর সংকট: বাংলাদেশের উপর কি ছায়া পড়ছে?

Last Updated on 4 months by admin

মোহাম্মদ এন. হক, জৌষ্ঠ বার্তা সম্পাদক, জাজিরা নিউজ: ভারতের জন্য কাশ্মীরের পর সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে মনিপুর। তবে এই সংকটের মূল কারণ শুধু বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নীতি নয়; বরং মনিপুরের দীর্ঘদিনের নৃগোষ্ঠীগত বিভাজন এবং ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বাস্তবতাও এর পেছনে রয়েছে। মেইতি ও কুকি-চীন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সাম্প্রতিক সহিংসতা মিলিয়ে এই অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে।

মনিপুরের ইতিহাস ও সংকটের সূচনা :

মনিপুর ১৯৪৯ সালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে মেইতি ও কুকি-চীনদের মধ্যে বৈষম্য এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বহু বছর ধরেই বিরাজমান। মেইতি হিন্দুরা মনিপুরের সমতলভূমি নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে কৃষি এবং উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বিদ্যমান। অন্যদিকে, কুকি-চীনরা পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করে, যেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এই বৈষম্যের প্রেক্ষিতে কুকি-চীনরা দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণের (ST) সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সম্প্রতি, হাইকোর্টের এক রায়ে মেইতি হিন্দুদের সংরক্ষিত উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার পর থেকে এই বৈষম্য নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে এবং সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে।

হিন্দুত্বের প্রভাব ও বিজেপির ভূমিকা:

বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নীতি মনিপুরের বিদ্যমান দ্বন্দ্বকে আরও ঘনীভূত করেছে। বিজেপি সরকার মেইতি হিন্দুদের সমর্থনে কাজ করায়, কুকি-চীন ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। বিজেপির এই নীতির প্রভাব উত্তর-পূর্ব ভারতে দেখা যাচ্ছে, যেখানে তাদের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বিশেষ করে, উত্তর-পূর্ব ভারতের খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে হিন্দুত্ববাদী নীতি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে এবং সম্প্রতি হওয়া নির্বাচনগুলোতে এটি প্রকাশ পেয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতি: সহিংসতা ও পতাকা পরিবর্তন:

সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে, মনিপুরে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। থৌবাল জেলায় বিক্ষোভকারীরা ভারতের জাতীয় পতাকা খুলে একটি মেইতি বিচ্ছিন্নতাবাদী পতাকা উত্তোলন করে। এই ঘটনা দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং মনিপুরের সংকটের নতুন দিকটি প্রকাশ করে। বিক্ষোভকারীরা মূলত স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিবর্তন দাবি করে এবং আধাসামরিক বাহিনীর প্রত্যাহার ও প্রশাসনিক দায়িত্ব রাজ্য সরকারের হাতে হস্তান্তরের দাবি জানায়।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সহিংসতা আরও বেড়েছে এবং মনিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। সহিংসতার ফলে অনেকেই নিহত ও আহত হয়েছেন, যার মধ্যে ড্রোন ও মিসাইল হামলার খবরও রয়েছে। তবে, মনিপুর পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের বিষয়টি ভুল এবং কেবল একটি পুরাতন পতাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।

চট্টগ্রাম কী প্রভাবিত হবে?

মনিপুরের সংকট বাংলাদেশ, বিশেষ করে চট্টগ্রামের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। চট্টগ্রামে কুকি-চীনদের প্রভাব খুবই সীমিত। বরং চট্টগ্রামে যেসব বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয়, তাদের বেশিরভাগই মিজোরামের স্বাধীনতাকামী মিজোদের সাথে সংযুক্ত। তবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে আরসা এবং অন্যান্য গোষ্ঠী আরও প্রভাবশালী। ফলে মনিপুরের সংকট সরাসরি চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে তেমন প্রভাবিত করবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা বাড়ার সম্ভাবনা থাকায় চট্টগ্রামের নিরাপত্তা বিষয়ে নজর রাখা উচিত।

ভারত কি বাংলাদেশ আক্রমণ করছে?

ভারত এমন কোনো পরিস্থিতিতে নেই যে তারা বাংলাদেশ আক্রমণ করবে। চীন এবং পাকিস্তান ইতিমধ্যেই ভারতের গলা চেপে ধরে আছে, বিশেষ করে সীমান্ত এলাকাগুলোতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ আক্রমণ করার মানে ভারতের নিজের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে ফেলা। বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ভারত বা বাংলাদেশের কোনো পক্ষের জন্যই লাভজনক নয়। বরং উভয় দেশের জন্যই শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। ভারতের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে আক্রমণ করা মানে নিজেদের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলা, যা কোনোভাবেই তারা করতে চাইবে না।

বাংলাদেশের অবস্থান কী হওয়া উচিত?

বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে সঠিক নীতি হবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। সাতবোনের অস্থিরতা যদি আরও বাড়ে, তবে বাংলাদেশের জন্য এটি নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তবে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে, বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। ভারতের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করা বাংলাদেশের জন্য কৌশলগতভাবে সঠিক হবে না, যতদিন না বাংলাদেশ পুরোপুরি ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসছে। তাই, নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বাংলাদেশের উচিত আঞ্চলিক অস্থিরতা পর্যবেক্ষণ করা এবং নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় থাকা।

তাহলে ভারত কি মনিপুর হারাবে?

ভারত ভৌগোলিকভাবে মনিপুর হারাবে না, তবে রাজনৈতিকভাবে এর নিয়ন্ত্রণ হারানোর সম্ভাবনা প্রবল। কুকি-চীন ও মেইতি সম্প্রদায়ের মধ্যকার সংঘাত এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নির্লিপ্ততা মনিপুরকে এক দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মনিপুর সংকটের সমাধান করতে হলে সামরিক পদক্ষেপের পরিবর্তে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এগোতে হবে, অন্যথায় এটি ভারতের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে যাবে।

সূত্র: The Diplomat, Scroll.in, The Wire, Free Press Journal, Northeast Today