সময়ের জনমাধ্যম

ইসলামের মৌলিকতা এবং আধুনিক সমাজের গ্রহণযোগ্যতার দ্বন্দ্ব

Last Updated on 7 hours by zajira news

মোহাম্মদ এন. হক, জৌষ্ঠ বার্তা সম্পাদক, জাজিরা নিউজ: ইসলামকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে নানা আলোচনা ও বিতর্ক প্রতিনিয়ত উঠে আসছে। বিশেষ করে সেক্যুলার সমাজে ইসলাম এবং তার চর্চা নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিছু অংশ ইসলামের সাথে বাঙালিত্ব বা স্থানীয় সংস্কৃতির সমন্বয় চাইছে, আবার কেউ কেউ ইসলামের মৌলিক রূপকে পরিবর্তন করার পক্ষপাতী। এসব বিতর্ক শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বেই মুসলমানদের ধর্মীয় চর্চার ওপর প্রভাব ফেলছে।

দেশের একটি সেক্যুলার গ্রুপ প্রায়শই বলে, “মুসলমান হও ভালো, তবে তুমি বাঙালি কেনো না?” তাদের বক্তব্যের মূলে রয়েছে একটি প্রশ্ন—তারা ধারণা করে যে, পুরোপুরি ইসলামী জীবনযাপন সম্ভব নয় যদি তা বাঙালি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়। তাদের মতে, একজন বাঙালি মুসলমান হতে হলে ইসলামের কিছু অংশকে বাদ দিতে হবে এবং বাকি অংশকে বাঙালি জীবনযাত্রার সাথে মানিয়ে চলতে হবে। অর্থাৎ, তাদের জন্য ধর্ম পালন মানে ইসলামের মৌলিক চর্চা বাদ দিয়ে যতটুকু সম্ভব তা নিজেদের জীবনযাত্রার সাথে খাপ খাওয়ানো।

একইভাবে, আরেকটি সেক্যুলার গ্রুপ বলে, “ইসলাম পালন করবেন, তবে সেটা আরবীয় বা ইরানী সংস্কৃতির মতো হবে না। বরং বাংলার সংস্কৃতির আলোকে একধরনের ‘লোকায়ত ইসলাম’ পালন করতে হবে।” তারা ইসলামের একটি স্থানীয় সংস্করণ চায়, যা তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ইসলামকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখবে। তাদের বক্তব্যের গভীরে রয়েছে যে, ইসলামের যে অংশগুলো তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, সেগুলো বাদ দিয়ে বাকি অংশগুলো পালন করতে হবে। তারা ইসলামের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক চর্চা বা প্রথা গ্রহণ করতে চায় না এবং এসবের পরিবর্তে একটি সংস্কৃতিগত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে চায়।

আন্তর্জাতিক মহলেও একই ধরনের চিন্তা দেখা যায়। অ্যামেরিকা যেমন বলে, “মডারেট মুসলিমদের নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু ফান্ডামেন্টালিস্টদের নিয়ে সমস্যা রয়েছে।” তাদের দৃষ্টিতে, ইসলামের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পালন করা যেতে পারে, কিন্তু ইসলামের মৌলিক বা কঠোর অনুসরণ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তারা চায় ইসলামকে সীমাবদ্ধ রাখা হোক, এবং এই সীমাবদ্ধতার বাইরে গেলে তা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের বক্তব্যের মূলে রয়েছে একটি নিয়ন্ত্রণের চিন্তা—কতটুকু ইসলাম চর্চা করা যাবে, তা নির্ধারণ করার একটি চেষ্টা।

এটি লক্ষ্য করা যায় যে, সেক্যুলারদের এই বক্তব্যগুলো মূলত ইসলামের চর্চাকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ করার চেষ্টা করে। তারা ইসলামের কোনো নির্দিষ্ট দিককে গ্রহণ করতে চায়, কিন্তু ইসলামের পুরো আকারে চর্চা বা পালনে তাদের আপত্তি রয়েছে। তারা মনে করে, ইসলামের কিছু অংশ তাদের সংস্কৃতি বা সামাজিক কাঠামোর সাথে খাপ খায় না এবং সেগুলো পরিবর্তন করা প্রয়োজন। মূলত তারা ইসলামের একটি নিয়ন্ত্রিত সংস্করণ তৈরি করতে চায়, যেটা তাদের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় এবং তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন মেটায়।

ইসলামের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার এই চেষ্টা বিভিন্ন পন্থায় প্রকাশ পায়।”ইসলাম ভালো, কিন্তু মৌলবাদীরা খারাপ।” অন্যদিকে কিছু মডারেট সেক্যুলার বলেন, “ইসলাম ভালো, তবে ‘ওহাবী’ বা ‘আরবীয়’ সংস্করণের ইসলাম এখানে মানায় না।” আবার পশ্চিমা শক্তিগুলো বলে, “ইসলাম ভালো, তবে ফান্ডামেন্টালিস্ট ইসলামের চর্চা আমাদের জন্য বিপজ্জনক।” এসব বক্তব্যে মূলত কিছু অংশকে বাদ দিয়ে ইসলামের একটি নির্দিষ্ট সংস্করণকে গ্রহণযোগ্য করার প্রচেষ্টা দেখা যায়।

তারা যে শব্দগুলো ব্যবহার করে, যেমন ‘মৌলবাদী’, ‘ওহাবী’, ‘আরবীয় ইসলাম’, ‘মরুভূমির ইসলাম’, ‘ফান্ডামেন্টালিস্ট’—এসব শব্দ মূলত ইসলামের কিছু অংশকে গ্রহণযোগ্য না বলে আখ্যায়িত করার একটি উপায়। তারা এই শব্দগুলোর মাধ্যমে ইসলামের কিছু অংশকে নেগেটিভ ট্যাগ দিয়ে সেগুলো বাদ দেয়ার চেষ্টা করে।

তবে, ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য এবং শক্তি তার পূর্ণতায় নিহিত। ইসলামকে টুকরো টুকরো করে গ্রহণ করা যায় না। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিকও নির্দেশ করে। ইসলামের প্রতিটি দিক, প্রতিটি নির্দেশনা মানবজাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে, এবং এর কোনো অংশকেই কম গুরুত্বপূর্ণ বলা যায় না। কিন্তু সেক্যুলারদের এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের মূল শিক্ষা এবং দর্শন থেকে বিচ্যুত করার একটি প্রচেষ্টা।

আজকের সমাজে, সেক্যুলার এবং পশ্চিমা মনোভাব ইসলামের ওপর যে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে, তা শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক প্রভাব। তারা ইসলামকে একটি গৃহপালিত সংস্করণে পরিণত করতে চায়, যেখানে ইসলামের মৌলিকত্ব হারিয়ে যাবে। তাদের জন্য গ্রহণযোগ্য ইসলাম মানে হচ্ছে এমন একটি ইসলাম, যা তাদের সমাজের সাথে খাপ খাবে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে যাবে না।

উপসংহার

ইসলামের পূর্ণতা এবং সার্বজনীনতাকে নষ্ট করে একটি নিয়ন্ত্রিত সংস্করণ তৈরি করার প্রচেষ্টা কখনোই সফল হতে পারে না। যারা ইসলামকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বা মতাদর্শের মধ্যে আটকে রাখতে চায়, তারা ইসলামের গভীরতা এবং শক্তিকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। সেক্যুলার বা পশ্চিমা শক্তির চাপের মুখেও ইসলামের পূর্ণ শিক্ষা এবং আদর্শকে ধরে রাখা মুসলমানদের দায়িত্ব।