Last Updated on 1 month by zajira news
অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: চট্টগ্রামে আদালত প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) ৪টার দিকে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় কারাগারে পাঠানোর সময় তাঁকে হত্যা করা হয়।
নিহত সাইফুল চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকার বাসিন্দা। তাঁর বাবার নাম জালাল উদ্দিন। সম্প্রতি তিনি চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ এনামুল বলেন, সাইফুল ইসলাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনি ২০১৮ সালে জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। পরে হাই কোর্টের আইনজীবী হিসেবেও নিবন্ধন পান। মোক্তার উদ্দিন সাগর নামে এক আইনজীবী বলেন, ‘আমার চোখের সামনে অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফকে কোপানো হয়েছে।’ চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দীন চৌধুরী বলেন, আদালত থেকে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে সাইফুল ইসলাম আলিফকে উগ্র ইসকনের সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। আলিফ সুপ্রিম কোর্ট বার ও চট্টগ্রাম বারের সদস্য ছিলেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন গণমাধ্যমকে জানান, চট্টগ্রাম আদালতে সংঘর্ষের ঘটনায় হতাহত ছয়-সাত জনকে হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে একজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। চিন্ময়ের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঢাকায় ৪ ও চট্টগ্রামে ৬ প্লাটুন বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, ঢাকার শাহবাগ, মৎস্য ভবন ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এলাকায় ৪ প্লাটুন এবং চট্টগ্রাম মহানগরে ৬ প্লাটুন বিজিবি সদস্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দায়িত্ব পালন করবেন।
সূত্র জানান, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে শুধু রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ নয়, ২০২৩ সালের জুনে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগে ‘ইসকন’ আন্তর্জাতিক শিশু সুরক্ষা অফিসের পরিচালক কমলেশ কৃষ্ণ দাস স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতিতে তাঁকে মন্দির এবং ধর্মীয় উপাসনালয়ের সব ধরনের কর্মকা থেকে বিরত রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এসব ধর্মীয় উপাসনালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ইসকনের স্থাপনায় রাতযাপনের অনুমতি এবং ১৮ বছরের নিচের বয়সের কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পু রিক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে (৩৮) গতকাল বেলা ১১টায় চট্টগ্রামের আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান আদালত। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলামের আদালত এ আদেশ দেন।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়ার পর বিক্ষোভ করেন তাঁর অনুসারীরা। আদালত থেকে বের করে তাঁকে প্রিজনভ্যানে তোলার পর প্রায় তিন ঘণ্টা আদালত চত্বরে প্রিজনভ্যান আটকে বিক্ষোভ করা হয়। দুপুর ১২টার দিকে প্রিজনভ্যানের ভিতর থেকেই চিন্ময় কৃষ্ণ তাঁর ভক্ত-অনুসারীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান। প্রিজনভ্যান থেকে হ্যান্ডমাইকে তিনি বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে নই। ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে যে রাষ্ট্র নির্মাণের আশা করা হয়েছে আমরা সনাতনীরা তার অংশীদার। সুতরাং রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হয় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নষ্ট হয় আমরা এমন কিছু করব না।’ এরপর প্রায় পৌনে ১টার দিকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসে এক পর্যায়ে তাঁদের বুঝিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলেও তাঁরা প্রিজনভ্যান আটকে বিক্ষোভ করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা পর বিকাল ৩টার দিকে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে এবং লাঠিচার্জ শুরু করে। এরপর সনাতনীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে লালদীঘি-কোতোয়ালি সড়কের রঙ্গম কনভেনশন হলের সামনে অবস্থান নেন। সেখানেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশের ইসকন সংস্থার প্রধান ও সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন খারিজ হওয়ায় ভারত গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশের চরমপন্থি গোষ্ঠীর দ্বারা লাগাতার হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণের ধারাবাহিকতায় এই গ্রেপ্তার ঘটেছে। বহু সংখ্যালঘুর আবাস এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা এবং লুটপাটের বহু প্রমাণিত তথ্য এসেছে। একই সঙ্গে বহু মন্দিরে চুরি এবং কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার নিয়ে ভারত ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়ার চেতনার পরিপন্থি। গতকাল রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। অত্যন্ত হতাশা ও গভীর দুঃখের সঙ্গে সরকার উল্লেখ করছে যে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার করার পর কিছু মহল ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। ভারতের এ ধরনের ভিত্তিহীন বিবৃতি শুধু ভুল তথ্য ছড়ানো নয়, বরং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়া চেতনার পরিপন্থি।
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যার প্রতিবাদে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে জেলা আইনজীবী সমিতি। আজ সব আদালতে এ কর্মসূচি পালন করা হবে বলে জানান সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘কোর্ট বিল্ডিং থেকে যাওয়ার পথে বিক্ষোভকারীরা যেদিকে পেরেছেন সেদিকে হামলা করেছেন। গাড়ি ভাঙচুর করেছেন, মসজিদের গ্লাস ভাঙচুর করেছেন। আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে সন্ধ্যায় নিউমার্কেট এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট জানান- স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ইসকন ইস্যুতে দেশি-বিদেশি ইন্ধন থাকতে পারে। দেশের নিষিদ্ধ দু-একটি দলও এর নেপথ্যে থাকতে পারে। গতকাল সন্ধ্যায় সিলেট সার্কিট হাউসে প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।
চট্টগ্রামে এক আইনজীবীকে হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীকে ধৈর্য ধারণ এবং কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রামের সব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসহ বন্দরনগরীতে নিরাপত্তা জোরদার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব সাজেদুর রহমান।
চট্টগ্রামে আদালত চত্বরে ইসকন সমর্থকদের হাতে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। গতকাল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজশাহী ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে প্রতিবাদী ছাত্র/ছাত্রীরা। আমাদের ঢাবি প্রতিবেদক জানান, আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে হত্যার প্রতিবাদে গায়েবানা জানাজা ও ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) কে উগ্রবাদী সংগঠন আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা।