সময়ের জনমাধ্যম

তরুণদের রাজনৈতিক দল গড়ার প্রস্তুতি- কীভাবে, কেমন হবে ?

Last Updated on 7 months by zajira news

অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: দেশের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে এবং গণমানুষের অভিপ্রায় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ছাত্র ও তরুণ সমাজ বরাবর অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সফল হয়েছে, যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।

২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে হাসিনা সরকারের টানা দীর্ঘ সাড়ে পনের বছরের অপশাসনের পতনের মাধ্যমে তারা আবারও প্রমাণ করেছে, একবার যদি তারা গণমানুষের সাধারণ ইচ্ছার পক্ষে ইস্পাতকঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে সে সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য।

১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ সালে যা হয়েছে, ২০২৪ সালেও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এখানে একটা কথা বলা আবশ্যক, প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্র ও তরুণ সমাজ অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকেও তাদের আন্দোলনের লক্ষ্যের প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে বিধায়, দেশের ইতিহাসের প্রতিটি আন্দোলনেরই প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে।

২০২৪-এর আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, প্রায় সব বয়সি নারীর বিপুল অংশগ্রহণ, যা ইতঃপূর্বে কোনো আন্দোলনে দেখা যায়নি।

জুলাই-আগস্টে স্বৈরাচারের পতন ঘটানো অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যেই এ দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে।

তবে এখনও তারিখ নির্ধারিত হয়নি। এরই মধ্যে তাদের দল গড়ার প্রস্তুতি নিয়ে তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। অনেকে কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় দলটি গঠন হবে তা জানতে কৌতূহলী।

শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের নীতি-আদর্শ, মেনিফেস্টোসহ অনেক বিষয়ই এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তা নির্ধারণ করা হবে। তবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অংশ নেবে দলটি। জানুয়ারিতেই দলটি আত্মপ্রকাশ করতে পারে। নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ‘প্রেসার গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করবে। যারা রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন, তারা এ দুই প্ল্যাটফর্ম থেকে পদত্যাগ করবেন।

রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্তরা জানান, তরুণদের ওই দুই প্ল্যাটফর্মের পাশাপাশি নতুন দলে যুক্ত হবেন নাগরিক সমাজের সদস্য ও বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। দলটি হবে যুবনির্ভর, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরুণ নেতারাও যুক্ত হতে পারেন।

এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে একটি সাংগঠনিক কাঠামো দেওয়ার কাজ করছেন। ইতোমধ্যে সংগঠনটির ২২ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। তৃণমূলে সংগঠনটির ভিত মজবুত করতে বিভিন্ন জেলায় কমিটি দেওয়া হচ্ছে। রংপুর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলা ও মহানগরের অন্তত ১৫টি কমিটি ঘোষণা করেছেন তারা।

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই সব জেলা ও মহানগরে কমিটি গঠনের কাজ শেষ হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সংগঠনটির মুখপাত্র আব্দুল হান্নান মাসউদ।

অন্যদিকে ৮ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্র পুনর্গঠন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও ‘নতুন বাংলাদেশের’ রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সফল করার লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির ৫৬ সদস্যের একটি কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। আত্মপ্রকাশের পর থেকে তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করতে কাজ করছেন নেতারা। ইতোমধ্যে অন্তত ৩০টি থানায় কমিটি দিয়েছে এ সংগঠন।

জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মনে করছে, দেশের মানুষ নতুন রাজনৈতিক দল দেখতে চায়।

জাতীয় নাগরিক কমিটির পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার সেক্রেটারি আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, আমাদের স্বাধীনতার মূলনীতি ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার। আরেকটি বড় লক্ষ্য ছিল এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি। কিন্তু গত ৫৩ বছর এখানে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যারা ক্ষমতায় ছিল, তারাই কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছে। সাধারণ মানুষ কিছু পায়নি।

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার নানাভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। ফলে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরের আন্দোলনে নানাভাবে সামাজিক সুবিচারের কথাটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং আন্দোলনে সক্রিয়, আহত ও শহীদ পরিবারের আকাঙ্ক্ষা তথা মানবাধিকার ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাবের প্রয়োজন।

এ সংগঠনে কারা যুক্ত থাকবেন- জানতে চাইলে আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, গত ১৫ বছরে যারা গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন, সামাজিক অধিকারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন, পেশাগত জায়গায় সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করেছেন, সবাইকে নিয়ে দলটি আবির্ভাব হবে। এটি কেবল নাগরিক কমিটি বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হবে না।

তিনি আরও বলেন, এর পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দলে যারা অ্যাক্টিভিস্ট আছেন, যারা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন করছেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবার মতামতের ভিত্তিতে এটি তৈরি হবে।

গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে যে তরুণ সমাজ এবং নাগরিকরা এসেছেন, ওই সময় তাদের মধ্যে একটা উদ্যোগের আকাঙ্ক্ষা দেখেছি। তারা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে দেশ পুনর্গঠন চান। সেই পুনর্গঠন ও উদ্যোগকে ফ্যাসিলিটেট করার জন্য জাতীয় নাগরিক কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। আমরা এর মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে বিভিন্ন জায়গায় কমিটি গোছাচ্ছি। ঢাকায় আমাদের ৫০ শতাংশ কমিটি গোছানো শেষ। সারা দেশেই কমিটি ঘোষণার কাজ চলমান।

রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা দেখেছি জনগণের মধ্যে একটি রাজনৈতিক দলের আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আশা করি আগামী এক দুই মাস পরই বাংলাদেশের মানুষের সামনে সুন্দরভাবে কোনো দলের বাস্তব রূপ দেখতে পাব। এটি জাতীয় নাগরিক কমিটির একক কোনো উদ্যোগ নয়, এটা তরুণদের উদ্যোগ। জাতীয় নাগরিক কমিটি সে উদ্যোগকে ফ্যাসিলিটেট করবে। আমাদের একটা আকাঙ্ক্ষা, নতুন রাজনৈতিক দল শহীদ ও আহতদের যে আকাঙ্ক্ষা, সে স্পিরিটটা তাদের ধারণ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও অ্যাক্টিভিস্ট মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক আহসান বলেন, বাংলাদেশে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তার ফলে একটা নতুন রাজনৈতিক শক্তি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির রাজনীতি নতুন বাংলাদেশে তাদের ফ্যাসিস্ট অতীতের কারণে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে এখন নতুন ভোটার বা ৩০ বছরের কম বয়সী ভোটার প্রায় ৩২ শতাংশ। এ ভোটাররা গত ১৬ বছরে কোনো ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাননি। নতুন রাজনৈতিক শক্তি যদি এ ভোটারদের আকর্ষণ করতে পারে, তবে তারুণ্যের বিকল্প শক্তি তৈরি হওয়া সম্ভব।

তরুণরা চাইলে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক মেরুর বাইরে চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এস এম রেজা। তিনি বলেন, এটি নির্ভর করবে জনগণ তাদের কীভাবে গ্রহণ করছে।

অধ্যাপক রেজা বলেন, রাজনৈতিক দল গঠনের গণতান্ত্রিক অধিকার যে কারও আছে। আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে এক ধরনের অথোরেটিয়ান শাসন জারি রেখেছিল। তারা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে যে পলিটিক্যাল ট্রেন্ড, এখানে দুটি বড় পোলার (মেরু) আছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে। জামায়াতে ইসলাম এখানে ইমার্জিং এখন। আমাদের মানুষের মানসিক সেটআপও এখানে এমন। নতুন করে তরুণরা এ চ্যালেঞ্জটা নিতে পারে। তারা যেহেতু অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাই তাদের নিয়ে আগ্রহ-আকাঙ্ক্ষার জায়গা তৈরি হয়েছে। প্রত্যাশার জায়গা তৈরি হয়েছে। এখন নির্ভর করবে মানুষ কীভাবে গ্রহণ করবে। সূত্র: বাংলানিউজ ও মানবকণ্ঠ