Last Updated on 2 weeks by zajira news
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: অনেক আরব দেশে প্রচলিত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ইসলাম একটি শক্তিশালী প্রতিবাদী শক্তি হয়ে উঠেছে। জনগণের অসন্তোষ প্রকাশ, জীবনযাত্রার অবস্থা প্রত্যাখ্যান এবং রাজনৈতিক বিকল্প খোঁজার প্রধান উপায় হয়ে উঠেছে এই আন্দোলন।
আরব শাসকেরা বহু বছর ধরে এ আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এটি এখনো কেন শেষ হয়নি? এটিকে ধ্বংস বা প্রতিস্থাপন করতে কি সব রকম উপায় ব্যবহার করা হয়নি? কঠোর দমন, সেনাবাহিনীর ব্যবহার, রাজনৈতিক চালবাজি—সবকিছু করেও কেন এটিকে থামানো যায়নি?
এই আন্দোলন টিকে থাকার রহস্য কী? পশ্চিমারা এটিকে ভয় পায়, আর ইসরায়েল মনে করে, এটি দীর্ঘ মেয়াদে তাদের জন্য বড় হুমকি।
অনেক গবেষক ও বিশেষজ্ঞ রাজনৈতিক ইসলামের পতন সম্পর্কে ভুল অনুমান করেছেন। ১৯৯০-এর দশক থেকে আরব বসন্তের পরও বারবার ধারণা করা হয়েছে, এই আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে।
কিন্তু প্রতিবার দেখা যায়, ইসলামপন্থীরা নতুন কৌশল, নেতৃত্ব এবং দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ফিরে আসে। এই পুনরুত্থান বারবার নতুন করে এই আন্দোলনের মূল কারণ ও পটভূমি বিশ্লেষণ করতে বাধ্য করেছে গবেষকদের ।
যখন আরব দেশগুলোর সরকার ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে (অর্থাৎ তাদের নির্বাচনে দুর্বল করে বা একেবারে বাদ দিয়ে দেয়) তখন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সামনে চলে আসে। তখন তারা মনে করে, অস্ত্র ও বিপ্লবই বর্তমান পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একমাত্র উপায়।
এ কারণেই যখন ইসলামিক স্টেট (আইএস) পিছু হটে, তখন হামাস আবার সামনে আসে। ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর হামলার মতো অভিযানের মাধ্যমে তারা ইসরায়েল ও পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়।
যখন আরব বিশ্ব গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে নীরব থাকে, তখন তা চরমপন্থী ইসলামের নতুন ঢেউকে শক্তিশালী করে। অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, এই ঢেউয়ের ধারাতেই হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) সম্প্রতি সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে ফেলে দিয়েছে।
অনেক আরব সরকার বহু দশক ধরে উপেক্ষিত থাকা সরকারি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছে, যাতে এসব সংস্থা আরব সমাজে ধর্মীয় বিষয়গুলো পরিচালনা করতে পারে। এ ছাড়া কিছু দেশ রাজনৈতিক ইসলামের বিকল্প হিসেবে ‘সুফি ইসলাম’-এর কথা ভেবেছে, যেখানে আধ্যাত্মিকতা গুরুত্ব পাবে, কিন্তু রাজনীতি থেকে আলাদা থাকবে।
এখন ইসলামপন্থীরা শুধু স্থানীয় নয়, বরং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠেছে। এইচটিএসের উত্থান তুরস্কের আঞ্চলিক ভূমিকার সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে ইরানের প্রভাব লেবাননের হিজবুল্লাহ ও গাজার হামাস পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে হামাসের কিছু অংশ তেহরানের চেয়ে আঙ্কারার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ।
ইসলামপন্থীরা টিকে আছে, তবে তা তাদের অতিরিক্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠার কারণে নয় বা তারা ভবিষ্যৎ–মুখী সমাধান ও নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারছে বলে নয়। বরং তাদের সরব উপস্থিতিকে আরব বিশ্বের রাজনৈতিক সংকটের প্রতিফলন বলা যেতে পারে।
এ মুহূর্তে ক্ষুব্ধ ও হতাশ আরব জনগণের সামনে ইসলামপন্থীরাই একমাত্র বিকল্প। কারণ, সরকারগুলো নিরাপত্তার নামে গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ত্যাগ করলেও তারা আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইসরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে গাজার জনগণের জন্য আরব সরকারগুলো কিছুই করতে পারেনি। অথচ শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও আধুনিক অস্ত্রের নামে সাধারণ জনগণের কল্যাণ ও স্বাধীনতাকে বলি দেওয়া হয়েছে। ইসলামপন্থীদের ভিলেন বানানোর পুরোনো কৌশল তরুণ প্রজন্মের কাছে আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা আর বর্তমান অবস্থা মেনে নিতে রাজি নয়। পরিবর্তনকেই তারা উত্তম বিকল্প মনে করছে।
অন্যদিকে উদারপন্থী ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এখনো ইসলামপন্থীদের বিকল্প হিসেবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি। ফলে ইসলামপন্থীরাই দীর্ঘ সময় ধরে অনেক দেশে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে আছে।
এটি এখনকার সময়ে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ধর্ম এখনো আরব সমাজে একটি শক্তিশালী প্রভাব রাখে। কয়েক দশক ধরে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও তা সাধারণত শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া নীতির কারণে ব্যর্থ হয়েছে।
নাদের হাশেমি তাঁর ইসলাম, সেক্যুলারিজম অ্যান্ড লিবারেল ডেমোক্রেসি বইয়ে লিখেছেন, ইসলামপন্থীদের বাদ দেওয়া, কোণঠাসা করা, বন্দী করা বা নির্বাসনে পাঠানোর মতো উপায়ে রাজনৈতিক ইসলামকে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বরং রাজনৈতিক ইসলামকে মূলধারার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে আরও গভীরভাবে সংযুক্ত করাই তাকে মোকাবিলার সঠিক পন্থা। রাজনৈতিক ইসলাম বা ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে তাদের পুরোপুরি সমাজ থেকে বাদ না দিয়ে বরং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত। এতে করে তারা গণতন্ত্র, বাস্তবতা এবং বিভিন্ন মতবাদকে গ্রহণ করতে শিখবে এবং সমাজের মধ্যে একযোগে কাজ করতে পারবে।
অনেক আরব রাষ্ট্র ইসলামপন্থীদের প্রভাব কমাতে ধর্মীয় ক্ষেত্রকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছে। তারা আইনের মাধ্যমে ধর্মীয় বিধান জারি, মসজিদে খুতবা দেওয়া ও ধর্মীয় নির্দেশনার নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে নিয়েছে। এর ফলে ইসলামপন্থীদের ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রভাব খর্ব হয়েছে। মিসরের রাজনীতিবিজ্ঞানী সাইফ এল-দিন আবদেল ফাত্তাহ এই নীতিকে বলছেন, ‘ধর্মের জাতীয়করণ’।
অনেক আরব সরকার বহু দশক ধরে উপেক্ষিত থাকা সরকারি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছে, যাতে এসব সংস্থা আরব সমাজে ধর্মীয় বিষয়গুলো পরিচালনা করতে পারে। এ ছাড়া কিছু দেশ রাজনৈতিক ইসলামের বিকল্প হিসেবে ‘সুফি ইসলাম’-এর কথা ভেবেছে, যেখানে আধ্যাত্মিকতা গুরুত্ব পাবে, কিন্তু রাজনীতি থেকে আলাদা থাকবে।
তবে এটি স্পষ্ট, এই নীতিগুলোর বেশির ভাগই সফল হয়নি এবং রাজনৈতিক ইসলাম এখনো আরব সরকারগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
মোহাম্মদ আবু রুম্মান জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।