সময়ের জনমাধ্যম

ফিলিস্তিন প্রশ্নে যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সৌদি আরব

এই নাটকীয় পরিবর্তনের কারণ হলো, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক নীতিতে গণহারে ফিলিস্তিনি জনগণকে স্থানান্তরের বিষয়টি যুক্ত হওয়া

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

Last Updated on 4 weeks by zajira news

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) একসময় রাজপরিবারের শক্তিশালী সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার মুখে ছিলেন। তখন তিনি বুঝতে পারেন যে ক্ষমতার পথ সুগম করতে হলে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেতে হবে। ২০১৭ সালে তিনি গোপনে ইসরায়েল সফর করে প্রভাবশালী ইহুদি গোষ্ঠীর মন জয়ের চেষ্টা চালান। ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রকাশ্য অবজ্ঞা দেখিয়ে তিনি পশ্চিমা বিশ্বকে আকর্ষণ করেন।

এর এক বছর পর, তিনি ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করে বলেন, ফিলিস্তিনিদের উচিত ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করা, নতুবা ‘চুপ করে থাকা’। হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলা চালানোর আগপর্যন্ত এমবিএস ক্রমেই আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। আব্রাহাম চুক্তি হচ্ছে ইসরায়েল এবং বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চুক্তি। এমনকি হামলার পরও সৌদি আরব তাদের স্বাভাবিক নীতিতেই অটল ছিল। টানা ১৫ মাস ধরে সৌদি আরবে কোনো ফিলিস্তিনপন্থী প্রতিবাদ করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি মক্কায় হাজিদেরও ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়ানো বা গাজার জন্য প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ ছিল।

সৌদি যুবরাজ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে অপমানও সহ্য করেছেন। প্রেসিডেন্ট হয়ে ট্রাম্প প্রথমে কোন দেশে সফর করবেন, এ প্রসঙ্গে ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, প্রথমে সৌদি আরব ভ্রমণ করলে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করতে হবে। এমবিএস তা মেনে ট্রাম্পকে ফোনকল করে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ট্রাম্প দাবি আরও বাড়িয়ে চুক্তির পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নিয়ে যান।

ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দিয়ে গাজাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। আর জানান যে গাজা পুনর্গঠনের খরচ বহন করবে উপসাগরীয় দেশগুলো, অর্থাৎ মূলত সৌদি আরব। এই দাবি সৌদি আরবের জন্য বিশেষভাবে অপমানজনক ছিল। এ ছাড়া ট্রাম্প দম্ভের সঙ্গে বলেন যে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের দাবি ছাড়াই সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে। কিন্তু এই বক্তব্যের ৪৫ মিনিটের মধ্যেই সৌদি আরব এর জবাব দেয়। এতে স্পষ্ট জানানো হয়, সৌদি আরব নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে, যাতে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ছাড়া সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে না।

এর জবাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চ্যানেল ফোরটিঙ্কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যেন বিদ্রূপ করেই বলেন, সৌদিরা চাইলে সৌদি আরবেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারে, ওদের কাছে অনেক জমি আছে! সপ্তাহের দ্বিতীয় বিবৃতিতে, রিয়াদ আরও কঠোর ভাষায় জানায়, ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজ ভূমির মালিক। তারা কোনো অনুপ্রবেশকারী বা অভিবাসী নয় যে ইসরায়েলি দখলদারেরা ইচ্ছেমতো তাদের উচ্ছেদ করবে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কোকে তারা চাপের মুখে ফেলে আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়েছিল। ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু একদম স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিকভাবে একঘরে করে দেওয়া। এত দিন তিনি সৌদি যুবরাজ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টকে আশ্বস্ত করছিলেন যে ইসরায়েল তাদের মিত্র হিসেবে বিবেচনা করবে। কিন্তু এখন তিনি বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল নিজের শর্তেই ‘শান্তি’ চাপিয়ে দেবে আর আরব বিশ্ব ইসরায়েলের সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।

এমন পরিস্থিতিতে সৌদি পররাষ্ট্রনীতির মোড় ঘুরে গেছে। সে এখন পাঁচ দশক আগের রাজা ফয়সালের আরব জাতীয়তাবাদী অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। ১৫ মাসের নীরবতার পর এখন ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব দেশগুলোর একটি সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গত রোববার গভীর রাতে মিসর ঘোষণা করেছে যে ২৭ ফেব্রুয়ারি তারা এক জরুরি আরব সম্মেলনের আয়োজন করবে। সম্মেলনের উদ্দেশ্য হবে ট্রাম্পের ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে উচ্ছেদ করে পুনর্বাসনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা।

এই নাটকীয় পরিবর্তনের কারণ কী? কারণ হলো, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক নীতিতে গণহারে ফিলিস্তিনি জনগণকে স্থানান্তরের বিষয়টি যুক্ত হওয়া। গাজার প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে জোর করে বিতাড়িত করলে তা প্রতিটি আরব দেশকে প্রভাবিত করবে। বিশেষত সৌদি আরবের ওপর এর গভীর প্রভাব পড়বে। ইসরায়েলের আগ্রাসীভাবে এই ভূখণ্ড দখল সমগ্র অঞ্চলকে অস্থির করে তুলতে পারে। আর তা হয়তো এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। এর ভয়াবহ পরিণতি সৌদি আরবের জন্যও বিপজ্জনক হবে।

২০১৭ সালে উপসাগরীয় দেশগুলো যে কারণে ফিলিস্তিন সংকটে নীরবতা বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছিল, সে পরিস্থিতি এখন আর নেই। অন্যদিকে, সিরিয়ায় অবস্থান হারানোর পর এবং হিজবুল্লাহর সাম্প্রতিক ক্ষয়ক্ষতির কারণে ইরানের প্রতিরোধ জোট দুর্বল হয়ে পড়েছে। তার বিরুদ্ধে চাপ বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে রাজি নয় সৌদি আরব। নতুন ইরানি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক এখন উষ্ণ। সৌদি যুবরাজ এমবিএস চান এই সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে।

এমবিএস নিজেও এখন দেশের ভেতর শক্ত ও দৃঢ় পরিস্থিতিতে আছেন। তাঁর ক্ষমতা এখন দৃঢ়। তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি আধুনিক ও সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে জনপ্রিয়। এমবিএসের ক্ষমতার শুরুর দিকে সৌদি আরব মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। এখন আর তেমনটা নেই। সব মিলিয়ে ট্রাম্প ও ইসরায়েল থেকে দূরত্ব বজায় রাখার ঝুঁকি সৌদি আরব নিতে পারে। তাহলে তারা নিজেদের নৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আবারও আরব ও মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রে নিয়ে আসার সুযোগ পাবে।

ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আই-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ, জাভেদ হুসেন