সময়ের জনমাধ্যম

থমথমে গোপালগঞ্জ, দিনভর হামলা-সংঘর্ষ, প্রাণহানি ৪ জন

Last Updated on 3 weeks by zajira news

অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতাকর্মীদের কর্মসূচিকে ঘিরে দিনভর দফায় দফায় হামলা, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় চারজনের প্রাণহানির পর কারফিউ জারির মধ্য দিয়ে শান্ত হয়ে আসা থমথমে এখন গোপালগঞ্জ শহর ।

বুধবার (১৬ জুলাই) এনসিপি নেতাকর্মীরা শহরের পৌর পার্ক মাঠে কর্মসূচি শুরুর আগেই সড়ক অবরোধকে কেন্দ্র করে পুলিশের গাড়িতে আগুন ও ইউএনওর গাড়িতে হামলা হয়। এনসিপি নেতাদের শহরে ঢোকার পরের পরিস্থিতি সামলাতে সাজোঁয়া যান নিয়ে নামতে হয় সেনা সদস্যদের। ছিল বিজিবির চার প্লাটুন সদস্য।

দেশজুড়ে ‘জুলাই পদযাত্রা’র ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যে এদিন ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে ‘ফ্যাসিস্ট মুজিববাদীরা’ হামলা চালায় বলে এনসিপি নেতারা অভিযোগ করেছেন। সকালে শহরের উলপুর ও টেকেরহাটে হামলা, ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনার পর বেলা দেড়টার দিকে পৌর পার্কের সমাবেশ মঞ্চে হামলা হয়।

কিছুক্ষণ পর মঞ্চে ফিরে কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করে পুলিশ ও সেনা পাহারায় মাদারীপুরের দিকে রওনা দিলে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা লঞ্চঘাট এলাকায় হামলার মুখে পড়েন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও গুলির শব্দে গোটা গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

হাতবোমা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের বিকট শব্দ আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে আতঙ্কে শহরের অধিকাংশ এলাকায় দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের চলাচলও সীমিত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিকালে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। তাতেও কাজ না হলে সন্ধ্যার পর জারি করা হয় কারফিউ।

সংঘর্ষের পর অন্তত চারজনের লাশ গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে আনার খবর আসে। আহত আরও ১৫ জনকে আনার তিনজনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। হামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বৃহস্পতিবার সারাদেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। পাশাপাশি ‘জুলাই পদযাত্রা’র পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিও বহাল রেখেছেন।

চলতি মাসের প্রথম দিন থেকে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছে এনসিপি। এরমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় এই কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে এনসিপি নেতাদের বুধবার সকালে ১১টায় গোপালগঞ্জে পৌঁছার কথা।

তার আগে মঙ্গলবার রাতে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ নামে একটি পোস্ট দেন। এনসিপি নেতাদের স্বাগত জানিয়ে শহরে নানা স্থানে তোরণ নির্মাণ করা হয়।

সে রাত থেকেই এনসিপির পদযাত্রাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা প্রচার-প্রচারণা চলতে থাকে। উসকানিমূলক পোস্টের পাশাপাশি নানা বিভ্রান্তিকর তথ্যও ছড়ানো হয়। ফলে এক ধরনের উত্তেজনা ও আতঙ্ক তৈরি হয় আগে থেকেই।

বুধবার সকাল থেকে শহরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে টহল দিতে দেখা যায়। শহড়জুড়ে বেশ কড়া নিরাপত্তা চোখে পড়ে। এর মধ্যেই এনসিপি নেতারা গোপালগঞ্জ শহরে পৌঁছার আগে সকালে শহরের উলপুর এলাকায় পুলিশের গাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে।

গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মীর মো. সাজেদুর রহমান বলেন, “এনসিপির পদযাত্রা বানচালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের জেলা সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালের সমর্থকেরা সদর উপজেলার উলপুর এলাকায় পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন দিয়েছে ও ভাঙচুর করেছে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়।”

পুলিশের গাড়িতে হামলা-অগ্নিসংযোগের পর পরই সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে গাড়িচালক আহত হন। ইউএনও এম রকিবুল হাসান বলেন, বেলা ১১টার দিকে স্থানীয়রা টেকেরহাট সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। খবর পেয়ে তিনি সেখানে যান। সেখানে একপর্যায়ে তার গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় গাড়িচালক মইন আহত হন।

এ ছাড়া, গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কে কাঠি নামক স্থানেও স্থানীয়রা বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে। কোটালীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি বা আশেপাশে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তাই প্রবেশপথে সাঁজোয়া যান নিয়ে অবস্থান নেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

এমন উত্তেজনা চলার মধ্যেই এনসিপি নেতারা দুপুর ২টার দিকে গোপালগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেন। তারা প্রায় ১০টি গাড়ির বহর নিয়ে সরাসরি শহরের পৌর পার্কে স্থাপিত মঞ্চে চলে আসেন। নেতারা রাস্তায় গাড়ি রেখে মঞ্চে গিয়ে অবস্থান নেন। এ সময় সেখানে প্রচুর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছিলেন।

তবে আগে বেলা দেড়টার দিকে কয়েকশ লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে সমাবেশস্থলে হামলা চালায়। তখন পুলিশ সদস্যরা পাশের আদালত চত্বরের দিকে চলে যান। হামলাকারীরা মঞ্চের সামনে রাখা চেয়ার ভাঙচুর করে। সেখানে আশপাশে টানানো ব্যানারও ছিঁড়ে ফেলে দেন।

কিছুক্ষণ পর সেখানে পুলিশ যায়। তখন এনসিপি নেতাকর্মী ও পুলিশ সদস্যরা মিলে হামলাকারীদের ধাওয়া দেয়। এতে হামলাকারীরা পিছু হটে। এর কিছুক্ষণ পর এনসিপি নেতারা মঞ্চে আসেন।

নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা মিছিল করে এসে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে পৌর পার্কে সমাবেশ মঞ্চে হামলা চালায় বলে এনসিপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ।

দফায় দফায় হামলা ও ভাঙচুরের পরও পুলিশের নিরাপত্তার মধ্যে শহরের পৌর পার্ক এলাকায় সমাবেশ মঞ্চে এসে বক্তব্য দেন এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এ সময় এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন, “‘মুজিববাদীরা’ আজকে বাধা দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে আমরা বলেছিলাম, বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই, সেই লড়াইয়ে জিততে হবে। এবং সেই লড়াইয়ে আমরা জিতেছিলাম। “আজকে আমাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। অচিরেই আমরা এর জবাব দেব ইনশাল্লাহ।”

গোপালগঞ্জের কর্মসূচি শেষ করে এনসিপি নেতারা তাদের পূর্বনির্ধারিত মাদারীপুর জেলায় যাওয়ার জন্য গাড়িবহর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। এ সময় তাদের সঙ্গে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গাড়িও ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পরই পৌনে ৩টার দিকে শহরের লঞ্চ ঘাট এলাকায় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে এই গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, আগে থেকেই সেখানে শত শত লোক জড়ো হয়েছিল। তারাই লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। এতে ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় সমাবেশস্থলের চেয়ারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম রাস্তায় এনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

ঘটনাস্থলে প্রচুর গুলির শব্দ শোনা যায়। সমাবেশ এলাকায় আগুন দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হামলাকারীদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। তখন হামলাকারীরা পাশের চৌরঙ্গী মোড়ে গিয়ে অবস্থান নেন। পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ি তাদের পিছু হটানোর চেষ্টা করে।

হামলার পর এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন তার ফেইসবুক আইডিতে লেখেন, “গোপালগঞ্জে লীগের জঙ্গিরা আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। গুলি করতেছে, বিস্ফোরণ করছে। সারাদেশে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।”

এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম অভিযোগ করে বলেন, “গোপালগঞ্জে খুনি হাসিনার দালালেরা আমাদের ওপরে আক্রমণ করেছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে নাটক দেখছে, পিছু হটছে। আমরা যদি এখান থেকে বেঁচে ফিরি, তাহলে মুজিববাদের কবর রচনা করেই ফিরব, না হয় ফিরব না। “সারাদেশের মানুষ গোপালগঞ্জের ছুটে আসুন। গোপালগঞ্জের বিবেকবান ছাত্র-জনতা জেগে উঠুন। দালালদের কবর রচনা করার আজকেই শেষ দিন।”

হামলার ঘটনার পর এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, “আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এই হামলা চালিয়েছেন। এ সময় পুলিশ-সেনাবাহিনী নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। “তাদের (এনসিপি) বলা হয়েছিল, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু তাঁরা সমাবেশস্থলে এসে দেখেন, পরিস্থিতি ঠিক নেই।”

হামলার পর পরই পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এনসিপি নেতাদের গাড়িবহর ঘুরিয়ে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানেই তারা বিকাল ৫টা পর্যন্ত অবস্থান করেন। পরে তাদেরকে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে করে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।

জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় চত্বরে এনসিপি নেতাদের সাঁজোয়া যানে উঠার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে।

এক মিনিট পাঁচ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে দেখা যায়, প্রথমে একটি সাঁজোয়া যানের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন এনসিপি নেতা সারজিস আলম, তিনি বেরিয়ে এসে হাসনাত আব্দুল্লাহকে নিয়ে আবার সাঁজোয়া যানে প্রবেশ করেন। সেখানে থাকা সেনাসদস্যরা তাদের সাঁজোয়া যানের ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করেন। সারজিস ও হাসনাত গাড়ির ভেতরে ঢোকার পর সেখানে প্রবেশ করেন। তারপর সেখানে এনসিপি নেতা আখতার হোসেন আসেন। কিন্তু তাকে সেই গাড়িতে না তুলে পাশের একটি গাড়িতে তোলা হয়।

আরেকটি ভিডিওতে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকেও একই ধরনের সাঁজোয়া যানে উঠতে দেখা গেছে। বিকালে অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম) খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, “এনসিপির নেতা-কর্মীরা গোপালগঞ্জ এসপি অফিসে আটকা ছিলেন। পরে সোয়া ৫টার দিকে ‘ক্লিয়ার’ হলে তারা চলে যান।”

এনসিপি নেতাদের গাড়িবহরে হামলা ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় পাশের জেলা প্রশাসকের বাসভবনেও হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এর কিছু পরে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগার চত্বর ও ফটকেও হামলা হয়। এতে কয়েকজন কারারক্ষী আহত হন।

তবে এসব ব্যাপারে জেলা প্রশাসন কিংবা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এই অবস্থার মধ্যে বিকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধরা জারি করা হয়।

সন্ধ্যার পর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক বার্তায় জানানো, বুধবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি থাকবে।

গোপালগঞ্জে হামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, অগ্নিসংযোগ ও গুলির ঘটনায় চারজন নিহত হওয়ার খবর এসেছে। গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেষ বিশ্বাস বুধবার রাত ৮টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এখানে চারজনের মরদেহ আনা হয়েছে।”

নিহতরা হলেন– শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (৩০), কোটালিপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (১৭), শহরের শানাপাড়ার সোহেল রানা (৩৫) এবং সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন।

শহরের প্রাণকেন্দ্র ও আশপাশের এলাকায় চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এ সংঘাতে বহু মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৫ জনকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পর গুরুতর আহত ৩ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।