সময়ের জনমাধ্যম

ভয়েস অব আমেরিকার জরিপ: আগের তুলনায় ‘বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে’ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়

ভয়েস অব আমেরিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট। ছবি: ভিওএর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

Last Updated on 7 months by zajira news

অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পাড়ছে। ভয়েস অব আমেরিকার এক জরিপে এমনটা দেখা গেছে। তবে জরিপের ফলাফলে নিরাপত্তা নিয়ে ধারণায় মুসলিম এবং অমুসলিমদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে।

গেল অক্টোবর মাসের শেষ দিকে পরিচালিত এই জরিপে দেখা গেছে, ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তুলনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে। মাত্র ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ মনে করেন বর্তমান সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য আগের চেয়ে কম নিরাপত্তা দিচ্ছে এবং ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ মনে করেন পরিস্থিতি আগের মতই আছে।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের তুলনা করতে বলা হয়। বাংলাদেশের জনতত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জরিপের ১ হাজার উত্তরদাতা বাছাই করা হয়। সেখানে সমান সংখ্যক নারী এবং পুরুষ ছিলেন, যাদের মধ্যে ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল মুসলিম।

উত্তরদাতাদের অর্ধেকের একটু বেশি ছিল ৩৪ বছর বয়সের নিচে। আর এদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহরে বসবাসকারী মানুষ।

বাংলাদেশে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যে প্রতিশোধ প্রবণতা দেখা যায়, তার বড় এক ধাক্কা গিয়ে পড়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে সনাতনী ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুদের ওপর। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা এবং ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘আমরা দেখেছি, সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক সম্পৃক্তরা কারণে তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, আবার শুধুমাত্র সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। পঞ্চগড়ে আহমদিয়াদের আবাসস্থলেও আক্রমণ হয়েছে, অগ্নিসংযোগ হয়েছে।’
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা যে বরাবরই ঝুঁকির মধ্যে থাকেন, সেদিকে ইঙ্গিত করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘কোনো সরকার তাদের অধিকার রক্ষার জন্য খুব একটা কিছু করে না।’

মীনাক্ষী গাঙ্গুলি ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী গোষ্ঠীকে ইচ্ছাকৃত ভাবে আলাদা করে রাখা হয়েছে এবং সামরিক বাহিনী আর কর্তৃপক্ষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। হিন্দু এবং আহমদিয়া সম্প্রদায় উগ্রবাদী সংগঠনের আক্রমণের শিকার হয়।’

তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রশাসন, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে সংখ্যালঘুদের উপাসনাস্থল পাহারা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য।

সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত গুম কমিশনের সদস্য নুর খান ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বেশ কিছু দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ আমরা লক্ষ্য করেছি, সাধারণ মানুষের তরফ থেকে, রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর তরফ থেকে। এর ফলে দেখা গেছে, পরবর্তী এক মাসের মধ্যেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে।’

জরিপে ফলাফলে নিরাপত্তা নিয়ে ধারণায় মুসলিম এবং অমুসলিমদের কিছুটা তফাৎ লক্ষ্য করা গেছে। মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতি আগের থেকে খারাপ। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ মনে করেন তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে খারাপ করছে।

ঢাকার বাসিন্দা জয়তী সরকার আগে কখনো তার বা পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। কিন্তু এখন তিনি নিশ্চিত নন বলে জানান।

একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী জয়তী সরকার বলেন, ‘আগের সরকারের সময় আমি আমার মেয়েকে নিয়ে রাত ১১টায় ধানমন্ডিতে আমাদের বাড়িতে ফিরেছি, কিছু মনে হতো না। কিন্তু এখন রাত আটটার দিকে মেয়েকে নিয়ে ফিরি, তখন আমার ভয় করে। আমি ২০ বছর ধরে ঢাকা শহরে আছি কিন্তু আগে এরকম ভয়ের মধ্যে থাকিনি কখনো।’

ভয়েস অব আমেরিকার জরিপে দেখা গেছে, মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬৬ দশমিক ১ শতাংশ মনে করছেন আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে। অন্যদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ এই ধারণার সঙ্গে একমত। অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে, আগের তুলনায় তারা বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে। জয়তী সরকার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও, তিনিও একটি স্বস্তির জায়গা দেখতে পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল, তাদের নেতা–কর্মীদের ছত্রছায়ায় লোকজন হিন্দুদের জমি অল্প দামে কিনেছে বা তাদের বিক্রি করতে বাধ্য করেছে। এখন আর এমনটা নাই। তাই একটা স্বস্তি বিরাজ করছে।’

ঢাকার বাসিন্দা এবং বেসরকারি সংস্থায় প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত হীরেন পণ্ডিত মনে করছেন, সম্প্রতি গ্রামে-গঞ্জে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আগস্ট-সেপ্টেম্বরের চেয়ে ভালো হয়েছে। তবে তিনিও শঙ্কার মধ্যেই আছেন।

হীরেন পণ্ডিত বলেন, ‘আমাদের গ্রামের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এখনো আমরা নিরপত্তা নিয়ে আশঙ্কার মধ্যে থাকি। একটা নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই।’

বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিয়মিত তাঁর সরকারের উদ্বেগের কথা সংবাদ মাধ্যমকে জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, দুই নেতা অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যসহ বাংলাদেশের সকলের জন্য মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে ৩১ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ও ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে লেখেন, ‘আমি হিন্দু, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বর্বর সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই যারা বাংলাদেশে মব দ্বারা আক্রমণ ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে, দেশটি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে।’

তবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ অভিহিত করে বলেছে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের খবর ‘অতিরঞ্জিত’ করে প্রচার করা হচ্ছে।

সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে ১৭ অক্টোবর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে ড. ইউনূস জানান, ‘কয়েকটি ক্ষেত্রে’ সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হন, কিন্তু সেগুলো ছিল ‘রাজনৈতিক’।

ইউনূস তাঁর ভাষণে বলেন, ‘অল্প যে সমস্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে।’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলন, ‘শেখ হাসিনার “নিপীড়নমূলক শাসনের” প্রতি ভারতের সমর্থনও হিন্দুদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে এবং আগামীতে দিল্লির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।’
গাঙ্গুলি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সব জায়গাতেই সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে চিন্তিত হওয়া। কিন্তু যেসব গোষ্ঠী ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে ঘৃণা এবং সহিংসতা ছড়াতে চায়, তাদের ব্যাপারে বিশেষ করে ভারতের আরও সাবধান হওয়া উচিত।’

বাংলাদেশে যেকোনো অজুহাতে হিন্দুদের নিশানা করার ঘটনা নতুন না। নুর খান যেমন বলছেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় ‘দুর্বলের প্রতি সবলের আঘাত আমরা বিগত দিনে দেখেছি এবং তার প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।’ তবে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন বলে জানান।

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যে শঙ্কা ছিল, সে শঙ্কা ক্রমান্বয়ে কেটে উঠছে এবং এক ধরনের স্বস্তি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আসতে শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনি বলা যাবে না, তারা সম্পূর্ণ আস্থাশীল হতে পেরেছে কিনা।’

নিরাপত্তা নিয়ে কতটুক আস্থাশীল হতে পারবেন, তা নিয়ে এখনো উদ্বিগ্ন জয়তী সরকার। অন্যান্য অনেক বাংলাদেশি মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো হিন্দুরাও তাদের সন্তানদের বিদেশ পাঠিয়ে দিতে অগ্রাধিকার দেন, কিন্তু তারা এখন এক বাড়তি চাপ অনুভব করছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি যখন অফিসে যাই, তখন আমাকে আমার মুসলমান কলিগরাই বলেন, দিদি আপনি চলে গেলেন না কেন, এখানে থাকবেন কেন? আগে যেই জোর দিয়ে আমি প্রতিবাদ করতাম, যে এটা আমার দেশ, আমি দেশকে ভালবাসি, দুই-তিন শ বছর ধরে আমরা এখানে আছি, আমরা কেন যাবো? কিন্তু এখন আর জোর দিয়ে প্রতিবাদটা আর করি না। কারণ আমি নিজে নিরাপদ ফিল করিনা।’

নুর খানের মতে, একটা আশঙ্কা অনেক মানুষের মধ্যেই আছে যে, আগামী তিন মাস পর চিত্র কী হবে। আস্থার সঙ্কট রয়েছে বলতে হয়।

তিনি বলেন, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থার জায়গাটা আরও মজবুত হবে কিনা, তা নির্ভর করবে আগামী ৬ থেকে ৯ মাসের কার্যক্রমের ওপর, সরকারের পদক্ষেপের ওপর।’

মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, সংখ্যালঘুদের তাদের অধিকার এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে জনসমক্ষে আশ্বস্ত করতে সরকার এবং ছাত্র নেতাদের আরও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।