Last Updated on 1 year by zajira news
অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: হালাল শব্দটি আরবি, যার অর্থ ‘অনুমোদিত’। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত রয়েছে:
• লেনদেনে ‘রিবা’ বা সুদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারবে না,
• হারাম (বেআইনি) সম্পদ কিংবা শূকর পণ্য, অ্যালকোহল বা সামরিক সরঞ্জাম ইত্যাদির মতো পণ্যে বিনিয়োগ করা যাবে না,
• ‘ঘারার’–ভিত্তিক বিনিয়োগ করা যাবে না। ঘারার হলো ‘অতি অনিশ্চিত লেনদেন কিংবা নিশ্চয়তার ধারণা ও ব্যবসায় স্বচ্ছতার সঙ্গে সংগত নয় এমন লেনদেন’।
২০১৫ সালে এই হালাল অর্থনীতির বাজারমূল্য ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ আট বছরেই এর আকার দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ২০২১ সালে হালাল অর্থনীতির বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার।
এ খাতের বিশ্লেষকেরা বলছেন, চার বছরের মধ্যেই এই বাজার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। বিশ্বে হালাল অর্থনীতির বাজারমূল্য আগামী বছর ৭ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাবে।
গত বছর প্রকাশিত আল–জাজিরা এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জেনারেল কাউন্সিল ফর ইসলামিক ব্যাংকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস বলেন, বিগত এক দশকে বৈশ্বিক ইসলামিক তহবিলের বাজার ৩০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি ডলার এখন বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে হালাল বা ‘শরিয়াহসম্মত’ বিনিয়োগ ও সুযোগ উভয়েরই চাহিদা বেড়েছে।
আল–জাজিরার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইসলামে বিনিয়োগের অনুমোদন রয়েছে তবে সুদ আরোপ কিংবা সুদ পরিশোধের মতো বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ের অনুমোদন নেই। সে কারণে মুসলমান সঞ্চয়কারী এবং বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে সুযোগের অভাব ছিল বলে মনে করা হয়।
ইসলামি আর্থিক গোষ্ঠী এথিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক উমর মুনশী বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শরিয়াহ পরিপালন। তবে ব্যবসাটি নৈতিক কি না, প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীর জন্য তা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, একটি ব্যবসার ফলাফল অবশ্যই সমাজ বা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব রাখবে না। সুতরাং শুধু সংগত হওয়ার ব্যাপার নয়, নেতিবাচক ফলাফলও পরিহার করতে হবে।
ইসলামিক ফাইন্যান্স কাউন্সিল ইউকের পরিচালক ওমর শেখ আল–জাজিরাকে বলেন, ‘হালাল বিনিয়োগ মূলত আপনার বিশ্বাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে আপনার টাকা ও অর্থের ব্যবস্থাপনা। মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন যে সমাজের জন্য ক্ষতিকর ও ধর্মীয় নৈতিকতার বিপরীত যেকোনো পদ্ধতির চেয়ে হালাল পথে অর্থ আয় করা ভালো।’
হালাল বিনিয়োগের একটি উদাহরণ হলো ইসলামি ব্যবসায় অর্থায়ন। এই ব্যবসা মুনাফা ভাগাভাগি মডেলের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। আরও আছে শরিয়াহসম্মত বিমা এবং সুকুক, যা মালিকানা নির্দেশ করে এমন একটি ইসলামিক আর্থিক সার্টিফিকেট। সুকুক বন্ডধারীরা একটি ব্যবসার আংশিক মালিকানা লাভ করেন, ফলে মুনাফার অংশ পান।
ওমর শেখ বলেন, একটি খাত হিসেবে ইসলামি অর্থ ব্যবস্থাপনা খুব বেশি হলে ৩০ বছরের পুরোনো। গত ১৫ বছরে এর সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন ঘটেছে। এসব বিষয়ে জানতে আর সচেতনতা তৈরি করতে সময় লাগে। এটা যখন ঘটছে, তখন আরও বেশি ব্যাংক হালাল বিনিয়োগের চাহিদা পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে। এর ফলে আরও বেশি আর্থিক পণ্য তৈরি হয়েছে, যা চাহিদা আরও বাড়িয়েছে।
যেসব পণ্য–ব্র্যান্ড ইসরায়েল ও গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধকে সমর্থন করছে বলে ভোক্তারা মনে করছেন, সেসব ব্র্যান্ড বর্জন করার একটি প্রচারণা এখন চলছে। হালাল বিনিয়োগের চাহিদা বাড়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে কাজ করছে।
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৩২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। স্মার্টক্রাউডের সহপ্রতিষ্ঠাতা সিদ্দিক ফরিদ বলেন, যুদ্ধের বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের মনে পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলেন, হালাল বিনিয়োগ অনেক দিন ধরেই বাড়ছে। তবে এ ধরনের বিনিয়োগ আরও জোরেশোরে বেড়েছে গত ছয় মাসে। মিলেনিয়াল ও অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে বৃদ্ধির হার বেশি।
সিদ্দিক ফরিদ বলেন, ‘আগে লোকজন খুঁজত হালাল কোনটি। হারাম না হলেই তারা খুশি হতো। এখন শুধু হালাল নয়, এটি তাদের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের সাথে যায় কি না, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্জন আন্দোলনের ফলে তারা এখন আরও বেশি সচেতন। কোনো জিনিস হালাল হতে পারে, তবে আপনি হয়তো সেটা ব্যবহার করতে চান না, কিংবা এর সঙ্গে জড়িত হতে বা এতে বিনিয়োগ করতে চান না।’
গোল্ডম্যান স্যাকস ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছিল যে ২০৭৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ১০টি বড় অর্থনীতির মধ্যে ৫টি অর্থনীতির দেশে ৮৫ কোটির বেশি মুসলমান জনগোষ্ঠী থাকবে। এই দেশগুলো হলো ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও মিসর।
যেহেতু জনসংখ্যা বাড়বে, তাই বাড়বে আর্থিক পণ্যের চাহিদা। ২০২৩ সালের স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২–২৩ অর্থবছরে শরিয়াহসম্মত বিনিয়োগে ২ হাজার ৫৯০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এক বছরে এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২৮ শতাংশ। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান দিনারস্ট্যান্ডার্ড প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।দুবাইয়ে আবাসন খাতের বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম স্মার্টক্রাউডের সহপ্রতিষ্ঠাতা সিদ্দিক ফরিদ বলেন, সাধারণভাবে বলতে গেলে এটা (ইসলামি বিনিয়োগ) বাড়ছে। মানুষজন এখন আরও বেশি জানে। তারা আরও বেশি সচেতন যে তাদের ডলার কীভাবে সারা বিশ্বের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে।
সিদ্দিক ফরিদ আরও বলেন, তাঁরা এখন আরও বেশি সাবধানী, ফলে তাঁরা আরও বেশি নৈতিকতার সঙ্গে বিনিয়োগ করছেন। হালাল বিনিয়োগ এর একটি বড় অংশ। বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এটি বাড়ছে। মিলেনিয়াল হিসেবে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা সামাজিকভাবে অনেক সচেতন। মানুষ এখন বোঝে তাঁদের টাকা কোথায় যাচ্ছে এবং কীভাবে তার ব্যবহার হচ্ছে। হালাল বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি এবং সহজে এসব বিনিয়োগ করার সুবিধা, এ ধরনের বিনিয়োগের চাহিদা বাড়াচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
অনলাইন আর্থিক প্ল্যাটফর্ম ইসলামিক ফাইন্যান্স গুরুর সহপ্রতিষ্ঠাতা ইব্রাহীম খান বলেন, ‘বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুসলিমরা খুব বেশি জানে এমন বলা যাবে না। এর একটি কারণ হলো মুসলমানদের জন্য বিনিয়োগের খুব বেশি বিকল্প নেই। এমনকি শরিয়াহসম্মত বিনিয়োগের বিষয়ে সাধারণ তথ্যও খুব বেশি পাওয়া যায় না।’তবে সামাজিক মাধ্যমের কারণে সচেতনতা বাড়ছে। ফলে বাড়ছে শরিয়াহসম্মত আর্থিক কর্মকাণ্ড। আর আর্থিক খাতের প্রযুক্তি, যা সহজে স্মার্টফোন ও ল্যাপটপে ব্যবহার করা যায়, তা বিভিন্ন হালাল বিনিয়োগের বিষয়ে তথ্য পেতে সহায়তা করছে।
এথিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক উমর মুনশী মনে করেন, সম্ভাব্য গ্রাহকদের বয়স এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, তরুণেরা অনলাইনে বিনিয়োগ করার বিষয়ে অনেক বেশি মুক্তমনা।
ইসলামিক ফাইন্যান্স কাউন্সিল ইউকের পরিচালক ওমর শেখ বলেন, ‘আপনার ফোনই আপনার সবচেয়ে কাছে থাকে। আর্থিক প্রযুক্তি এখান থেকেই শুরু করতে পারে। এমন সমাধান নিয়ে আসতে পারে, যা দক্ষ ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করে এবং একই সঙ্গে খুচরা গ্রাহকদের জন্য পছন্দসই। অনেক ব্যাংক এখন আর্থিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান বের করছে কিংবা আর্থিক প্রযুক্তির দিকে নজর দিচ্ছে।’