Last Updated on 5 months by zajira news
নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: রাজধানীর ইস্কাটনে বহুতল ভবন ইউনিক হাইটসের চতুর্থ তলায় অবস্থিত ঢাকা সড়ক পরিবহন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয়টি বেশ সুসজ্জিত ও সুপরিসর। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এখান থেকেই দেশের পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করা হতো।
ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের পর ১৩ আগস্ট কার্যালয়টির নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন বিএনপিপন্থী পরিবহন নেতারা।
গনমাধ্যমে এসেছে, সারা দেশে পরিবহন খাত থেকে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়। এর মধ্যে প্রতিটি বাস-ট্রাক থেকে প্রতিদিন প্রকাশ্যে তোলা হয় ৭০ টাকা। ‘গেটপাস বা জিপি’ কিংবা সমিতির সদস্য ফি—এ জাতীয় নানা অজুহাতে দৈনিক, মাসিক ও এককালীন আরও বিপুল টাকা চাঁদা তোলা হয়।
সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সড়ক খাতের এ ব্যাপক চাঁদাবাজিরও হাতবদল হয়ে গেল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।সরকার পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মগোপনে। পরিবহন সমিতিগুলোর অফিস বিএনপি নেতাদের দখলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ঢাকাসহ সারা দেশের মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তাঁর সহযোগী ছিলেন জাতীয় পার্টির নেতা মসিউর রহমান (রাঙ্গা)। সরকার পতনের আগেই দেশ ছেড়েছেন এনায়েত। আত্মগোপনে আছেন মসিউর রহমান।
এ সুযোগে ১০ আগস্ট কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন পরিবহন নেতা মিছিল নিয়ে এসে ইউনিক হাইটসের কার্যালয়ের তালা ভাঙেন। এরপর ১৩ আগস্ট কার্যালয়টি দখলে নেন তাঁরা। এর পরদিন সাইফুলের নেতৃত্বে ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়।
সাইফুল ইসলাম আগের দুই দফা বিএনপির শাসনামলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দুবারই তাঁর সভাপতি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এবারও মির্জা আব্বাসই তাঁদের পেছনে রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সাইফুলের বাড়ি কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জে। তাঁর পরিবহন কোম্পানির নাম ইলিয়টগঞ্জ এক্সপ্রেস। আর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ঢাকা পরিবহন নামে মির্জা আব্বাসের বাস চলাচল করত।
পরিবহনমালিকদের সূত্র বলছে, ময়মনসিংহ পথে এনা পরিবহনের ব্যানারে এনায়েত ছাড়াও সাইফুল, ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের নেতা আমিনুল হক শামীম, শ্রমিকনেতা ওসমান আলীর বাস চলত। সেগুলো এখন ‘ইউনাইটেড’ নাম নিয়ে চলছে। এর বাইরে রাজধানীর সায়েদাবাদ ও গাবতলী টার্মিনালেরও নিয়ন্ত্রণ বদলে গেছে। মহাখালী হাতবদলের পথে। সারা দেশে একই অবস্থা চলছে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে তাঁরা দায়িত্ব নিয়েছেন। চাঁদাবাজি বন্ধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেন। আগের মতো মির্জা আব্বাসের যুক্ত থাকার সম্ভাবনা নিয়ে সাইফুল বলেন, তিনি এখন ব্যস্ত। উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন।
কার্যালয় ও সমিতির নিয়ন্ত্রণ বদলে যাওয়ার পর খন্দকার এনায়েত উল্যাহর মালিকানাধীন ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে এনা পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিলেটসহ অন্যান্য পথে যেসব বাস চলাচল করে, সেগুলোও হুমকির মুখে।
পরিবহনমালিকদের সূত্র বলছে, ময়মনসিংহ পথে এনা পরিবহনের ব্যানারে এনায়েত ছাড়াও সাইফুল, ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের নেতা আমিনুল হক শামীম, শ্রমিকনেতা ওসমান আলীর বাস চলত। সেগুলো এখন ‘ইউনাইটেড’ নাম নিয়ে চলছে। এর বাইরে রাজধানীর সায়েদাবাদ ও গাবতলী টার্মিনালেরও নিয়ন্ত্রণ বদলে গেছে। মহাখালী হাতবদলের পথে। সারা দেশে একই অবস্থা চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি দীর্ঘদিন ধরেই এক কার্যালয় থেকে পরিচালিত হতো। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মালিক সমিতির কার্যালয় ছিল মতিঝিলে বিআরটিসি ভবনে। বছর ছয়েক আগে ইউনিক হাইটসে আট হাজার বর্গফুটের অফিস নেওয়া হয়। জায়গা কেনা ও সুসজ্জিত করতে ব্যয় হয় প্রায় ১৫ কোটি টাকা।
এরই মধ্যে রাজধানীর সায়েদাবাদ, জয়কালী মন্দির ও গাবতলী বাস টার্মিনালে শাজাহান খানের নিয়ন্ত্রণাধীন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়গুলো বিএনপিপন্থীরা দখলে নিয়েছেন। ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে বাস ও ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের দুটি কার্যালয়ই হাতবদল হয়েছে। রংপুর, নীলফামারীর সৈয়দপুর ও জামালপুরেও শাজাহান খানের লোকজন কর্তৃত্ব হারিয়েছেন।
এর বাইরে গাবতলী বাস টার্মিনালভিত্তিক সংগঠন আছে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এ সংগঠনের সভাপতি শ্যামলী পরিবহনের স্বত্বাধিকারী রমেশ চন্দ্র ঘোষ ও সাধারণ সম্পাদক আবু রায়হান। পটপরিবর্তনের পর তাঁরাও কার্যালয়ে আসছেন না বলে জানা গেছে। বিএনপির স্থানীয় নেতা ও হানিফ পরিবহনের মালিক কফিল উদ্দিন এখন ওই কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এই সমিতি নিয়ন্ত্রণ করতেন দলটির সাবেক সংসদ সদস্য জি এম সিরাজ।
অবশ্য কফিল উদ্দিন দাবি করেন, তিনি সমিতির কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেননি। নেতারা আসছেন না। তাই কর্মচারীরাই এখন সমিতি চালাচ্ছেন।
গবেষণায় আরও এসেছে, দেশের বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতিবিদেরা সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত।
সারা দেশের পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনে এত দিন একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের। পটপরিবর্তনের পর তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা মতিঝিলে সংগঠনের প্রধান কার্যালয়ে আসছেন না।
এ সুযোগে তাঁদের অধীন থাকা টার্মিনাল, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক ইউনিয়ন কমিটির কার্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণও হাতবদল হওয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে রাজধানীর সায়েদাবাদ, জয়কালী মন্দির ও গাবতলী বাস টার্মিনালে শাজাহান খানের নিয়ন্ত্রণাধীন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়গুলো বিএনপিপন্থীরা দখলে নিয়েছেন।
ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে বাস ও ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের দুটি কার্যালয়ই হাতবদল হয়েছে। রংপুর, নীলফামারীর সৈয়দপুর ও জামালপুরেও শাজাহান খানের লোকজন কর্তৃত্ব হারিয়েছেন।
শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন ফেডারেশনের কমিটিতে আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি, বাসদ, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলের লোকজন আছেন। বর্তমান কমিটিতে কার্যকরী সভাপতি আবদুর রহিম বখশ ও সহসভাপতি শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান বিএনপির নেতা। অন্যদিকে কাজী মোতাহার হোসেন, মোখলেছুর রহমানসহ আরও অনেক প্রভাবশালী নেতা আওয়ামী লীগের। সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বাসদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সব দলের প্রতিনিধি থাকলেও এত দিন মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল শাজাহান খানের। বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের আমলে দলটির নেতা হবিবুর রহমান খান সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কর্তৃত্ব করতেন। তিনি এখন জীবিত নন। এবার রহিম বখশ ও শিমুল বিশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। এমনকি একপর্যায়ে শাজাহান খানকে হটিয়ে বিএনপির কেউ মূল নেতৃত্বে চলে আসতে পারেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিবহন খাতে তিন পদ্ধতিতে চাঁদা তোলা হয়। এক) দৈনিক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদা; দুই) বাস-মিনিবাস নির্দিষ্ট পথে নামানোর জন্য মালিক সমিতির চাঁদা এবং তিন) রাজধানী ও এর আশপাশে কোম্পানির অধীন বাস চালাতে দৈনিক ওয়েবিল বা গেটপাস (জিপি) চাঁদা।
গত ৫ মার্চ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রকাশ করা এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়। এই চাঁদার ভাগ পান দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা।
গবেষণায় আরও এসেছে, দেশের বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতিবিদেরা সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিবহন খাতে তিন পদ্ধতিতে চাঁদা তোলা হয়।
এক) দৈনিক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদা; দুই) বাস-মিনিবাস নির্দিষ্ট পথে নামানোর জন্য মালিক সমিতির চাঁদা এবং তিন) রাজধানী ও এর আশপাশে কোম্পানির অধীন বাস চালাতে দৈনিক ওয়েবিল বা গেটপাস (জিপি) চাঁদা।
ক্ষমতা বদলের পর অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের পরিবহন খাতের কার্যালয় দখলের মূল লক্ষ্য হচ্ছে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ। আর চাঁদাবাজির কারণেই পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা, বাড়তি ভাড়ার নৈরাজ্য। এর মূল ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ।
বিআরটিএর হিসাবে দেশে বাস, মিনিবাস ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান আছে প্রায় তিন লাখ। তিন পদ্ধতির অধীন এসব যানবাহন থেকে বছরে অন্তত ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা চাঁদা ওঠে।
দেশে নিবন্ধিত পরিবহন শ্রমিক সংগঠন আছে ২৪৯টি। এগুলো নিয়ে গঠিত জাতীয় সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এ ফেডারেশনে দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শাজাহান খান। তাঁর পরিবারের নামে বাস কোম্পানি আছে। তাঁর ছেলে আসিবুর রহমান খান মাদারীপুর জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি জাতীয় পার্টির নেতা মসিউর রহমান। মহাসচিব আওয়ামী লীগের নেতা খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তাঁদের অধীন দেশে ৬৪ জেলা ও বড় শহরগুলোর বাস-ট্রাক টার্মিনালে মালিকদের সমিতি আছে।
সব মিলিয়ে মালিক-শ্রমিকদের তিন শতাধিক কমিটির মাধ্যমে চাঁদা তোলা হয়। এর বাইরে ফেরিঘাট, টোল প্লাজাসহ আরও অঘোষিত বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি হয়।আওয়ামী লীগের প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দলটির সংসদ সদস্য ও নেতাদের অনেকেই ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় পরিবহন ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতির।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ক্ষমতা বদলের পর অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের পরিবহন খাতের কার্যালয় দখলের মূল লক্ষ্য হচ্ছে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ। আর চাঁদাবাজির কারণেই পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা, বাড়তি ভাড়ার নৈরাজ্য। এর মূল ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ। তিনি আরও বলেন, ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের সংস্কার।
ক্ষমতা পরিবর্তনের পরই রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছাত্র–জনতার লক্ষ্যের বিপরীত। এভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কারণে অতীতে দেখা গেছে পরিবহন খাতের নেতারা সরকারের চেয়েও বেশি শক্তিশালী মনোভাব দেখিয়েছেন। ফলে এই খাতের বিশৃঙ্খলা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। সূত্র, প্রথম আলো