Last Updated on 3 weeks by zajira news
অনলাইন ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পে দেশের তিন জেলায় শিশুসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) ছুটির দিনের সকালে ১০টা ৩৮ মিনিটে এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৭; উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার পাশে নরসিংদীর মাধবদীতে।
২৬ সেকেন্ড স্থায়ী এ ভূমিকম্পে প্রাথমিকভাবে আতঙ্ক ছড়ায়, বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। এরপর আসতে থাকে প্রাণহানি আর ক্ষয়ক্ষতির তথ্য।
এই ভূখণ্ডে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেরও ইতিহাস রয়েছে। তবে গত কয়েক দশকের মধ্যে এমন প্রাণঘাতি ভূমিকম্প দেশের মানুষ আর দেখেনি।
ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, “দুটো প্লেটের সংযোগস্থলে এ ভূমিকম্পটি হয়েছে, ইন্দো-বার্মা টেকটোনিক প্লেটে। ভূমিকম্পের কম্পনের তীব্রতা ছিল বেশ। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।”
এক বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আরমানিটোলার কসাইটুলি এলাকার একটি ৮ তলা ভবনের পাশের দেয়াল এবং কার্নিশ থেকে ইট ও পালেস্তারা খসে নিচে পড়ে, যেখানে একটি গরুর মাংস বিক্রির দোকান ছিল।
সেখানে থাকা ক্রেতা ও পথচারীরা আহত হন। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় লোকজন তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা ৩ জনকে মৃত ঘোষণা করেন।
বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন নিহতরা হলেন আনুমানিক ২২ বছর বয়সী রাফি উল ইসলাম, হাজী আবদুর রহিম (৪৭) ও তার ছেলে মেহরাব হোসেন রিমন (১২)।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার একটি ভবনের দেয়াল ধসে দশ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। রূপগঞ্জ থানার ওসি তরিকুল ইসলাম বলেন, “শুক্রবার সকালে উপজেলার গোলাকান্দাইল এলাকায় এ ঘটনায় শিশুটির মাসহ আরও দুজন আহত হন। নিহত শিশু ফাতেমা ওই এলাকার আব্দুল হকের মেয়ে; তিনি ঢাকার শ্যামবাজারে ব্যবসা করেন।
নরসিংদীতে পলাশ উপজেলার মালিতা গ্রামে মাটির ঘরের দেয়াল ধসে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির প্রাণ গেছে বলে পলাশ থানার ওসি মনিরুল ইসলাম। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেছেন, নিহতের নাম তাৎক্ষনিকভাবে জানা যায়নি, তার বয়স ৬৫ বছর।
নরসিংদী সদর থানার গাবতলি এলাকায় বাড়ির সানশেড ভেঙে পড়ে আহত হয় ১০ বছর বয়সী ওমর তার দুই বোন ও তার বাবা দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল। দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ওমরের মৃত্যু হয় বলে হাসপাতালের পুলিশ ক্যম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক জানিয়েছেন। উজ্জ্বল গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
এদিকে গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজের উপ-পরিচালক আব্দুল সালাম সরকার বলেন, “এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ভূমিকম্পে কম বেশি আহত হয়ে ১৫-২০ জনের মত এ হাসপাতালে এসেছেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের তিনতলা ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের চারতলা থেকে নিচে লাফ দিয়ে তিন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এছাড়া সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা ভেঙেছেন ছাত্রদল নেতা তানভীর বারী হামিম, আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
কলাবাগানের লেক সার্কাস রোড, হাতিরপুল, সেন্ট্রাল রোড, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, এলিফেন্ট রোড, মিরপুর, গুলশান, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়, মানুষকে দ্রুত ভবন ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় কে কার আগে নামবেন তা নিয়ে তাদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিও হয়।
ঢাকায় অনেক ভবনে ফাটল ও পলেস্তরা খসে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাংবাদিক ইমরান হোসেন জানান, শুক্রবার সকালে ঘুমের মধ্যে শক্ত ঝাঁকুনি অনুভব করে অনেকেই বিচলিত হয়ে পড়েন। ভূমিকম্প টের পেয়ে অনেকেই বাসভবন থেকে বেরিয়ে পড়েন। অনেক ভবনে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। ঘটনার এক ঘণ্টা বাদেও বাসায় ঢুকতে ভয় পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শেলফ থালা-বাসন নিচে পড়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতি দেখতে কোনো জরুরি সাড়াদানকারী দলকে তিনি দেখেননি। মেরামতের জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। নিউ মার্কেট থানার ওসি এ কে এম মাহফুজুল হক বলেন, তাদের থানা ভবনের ৩,৪ ও ৫ তলায় ফাটল ধরেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসিন হল, কবি জসীমউদ্দিন হল, স্যার এ এফ রহমান, মোকাররম ভবন, শেখ ফজলুল হলসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। গাজীপুরে হেলে পড়েছে ছয়তলা একটি ভবন, ফাটল ধরেছে এক মাদ্রাসার দেয়ালে।
টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, “স্টেশন রোডে একটি ছয় তলা ভবন হেলে আরেকটি ভবনের সঙ্গে লেগে গেছে। এতে ভবনটির বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।”
ভূমিকম্পের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ভূমিকম্প টের পেয়ে আতঙ্কিত মানুষ ছুটে ভবনের নীচে নেমে ফাঁকা জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বহুতল ভবনগুলোতে মানুষ পিলার ধরে থাকার কথা জানিয়েছেন। অনেকে ভূমিকম্পের সিসি ক্যামেরার ভিডিও শেয়ার করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের একটি কক্ষের জিনিসপত্র তছনছ হয়ে গেছে।
বেলা ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।
১. আরমানিটোলার কসাইটুলি এলাকায় ৮ তলা ভবন ধসে পড়ার খবর পেয়ে সদরঘাট ও সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশন থেকে দুটি ইউনিট সেখানে যায়। তারা দেখতে পায় পলেস্তারার কিছু আলগা অংশ এবং কিছু ইট খসে পড়েছে। ভবনের কোনো ক্ষতি হয়নি।
২. খিলগাঁও নির্মাণাধীন ভবন থেকে পার্শ্ববর্তী দোতলা একটি ভবনে একটি ইট পড়ে একজন আহত হয়েছেন। স্থানীয় লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
৩. বারিধারা ব্লক-এফ, রোড-৫ এ একটি বাসায় আগুনের খবর পাওয়া যায়। বারিধারা ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট সেখানে গিয়ে আগুন নেভায়। ভূমিকম্পের কারণেই ওই আগুন লেগেছিল কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
৪. সূত্রাপুর স্বামীবাগ আট তলা একটি ভবন অন্য একটি ভবনে হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। সূত্রাপুর ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গেছেন।
৫. প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। কোনো ক্ষয়ক্ষতি নেই।
৬. কলাবাগানের আবেদখালী রোডে একটি ৭ তলা ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশন থেকে একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ভবন ঠিক আছে, লোকজন আতঙ্কিত হয়ে ফোন করেছিল।
৭. মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় একটি বাসা বাড়িতে আগুন লাগে। গজারিয়া ফায়ার স্টেশন থেকে দুটি ইউনিট সেখানে গেছে।
ভূমিকম্পের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি। বোর্ড জানিয়েছে, উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে।
পিডিবি এক বার্তায় বলেছে, “শক্তিশালী ভূমিকম্পজনিত কারণে দেশের বিভিন্ন স্হানে অবস্থিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও সরবরাহ ব্যবস্হায় সাময়িক বিঘ্ন ঘটেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।” কিছু সময়ের জন্য বিঘ্নিত হয়েছে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক।
প্রধান উপদেষ্টার বার্তা
রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্পের ঘটনায় পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকার।জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এক বার্তায় এই কথা জানিয়েছেন। বার্তাটি প্রধান উপদেষ্টার ফেরিফায়েড ফেইসবুকে দেওয়া হয়েছে দুপুর ১টায়।
বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে যেসব ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দ্রুততার সঙ্গে সাড়া দিয়েছেন।” কোনো ধরনের গুজব বা বিভ্রান্তিতে কান না দিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, “প্রয়োজনে হটলাইনসহ সরকারি চ্যানেলে পরবর্তী দিক নির্দেশনা জানানো হবে। নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
এ ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ এবং আতঙ্ক জন্মেছে তা নিয়ে সরকার অবগত আছে। এবং সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরকে অবিলম্বে মাঠপর্যায়ে নেমে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে বার্তায় জানানো হয়েছে।


