সময়ের জনমাধ্যম

দেশের স্বার্থে সব দল ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার

ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বুধবার (০৪ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে ফটোসেশনে অংশ নেন।

Last Updated on 7 months by zajira news

নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে । সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের অপপ্রচার, হস্তক্ষেপ ও উসকানির বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে দলগুলো।

গতকাল বুধবার (০৪ ডিসেম্বর) বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যৌথ সংলাপে এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা ।

সংলাপের শুরুতে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। তিনি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে তা রুখে দিতে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি, একযোগে পেয়েছি। কোনো মতভেদের মাধ্যমে পাইনি, কাউকে ধাক্কাধাক্কি করে পাইনি। যারা আমাদের বুকের ওপর চেপে ছিল, তাদের বের করে দিয়েছি।

৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি, সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে একজন আইনজীবীকে হত্যার ঘটনা, বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠাতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আরজি জানানো এবং সবশেষ আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনা ঘটেছে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে গতকাল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল, বাম দলসহ ৩৫টির মতো রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেন। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এই সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা সূচনা ও সমাপনী বক্তব্য দেন।

বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এই সংলাপে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলম উপস্থিত ছিলেন। পরে আইন উপদেষ্টা বৈঠকের বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেন। তিনি বলেন, ‘আজকের বৈঠকে উপস্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা ছিল। তবে সবাই দেশের প্রশ্নে, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।’
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাসদ, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ জাসদ, জেএসডি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিসসহ অন্যান্য দল ও সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা সংলাপে অংশ নেন। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এসেও ফরেন সার্ভিস একাডেমির ফটক থেকে ফিরে যান। তাঁর সঙ্গে দলের মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদও ছিলেন।

আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈঠকে সবাই মিলে একটি সমাবেশ করা, সবাই মিলে একটি পলিটিক্যাল কাউন্সিল করা, নিরাপত্তা কাউন্সিল করাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছে। তবে সভার মূল সুর ছিল, আমাদের মধ্যে মত, পথ ও আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে, অবস্থানে ভিন্নতা থাকতে পারে; কিন্তু দেশ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাই এক। সবার ওপরে দেশ। এই রাজনৈতিক সমাবেশের মাধ্যমে এই বার্তা জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে।’

আসিফ নজরুল বলেন, বৈঠকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের হওয়া চুক্তিগুলো প্রকাশ করা এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ দেশের জন্য ক্ষতিকর চুক্তি বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের যে অর্থনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের যে চেষ্টা, অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপের যে চেষ্টা, তার নিন্দা জানিয়েছেন উপস্থিত রাজনীতিবিদেরা। পাশাপাশি তাঁরা ভারতকে মর্যাদাশীল এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

গতকালের বৈঠকে বিএনপির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। এর নেতৃত্ব দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির যে অপচেষ্টা হচ্ছে, আমরা সরকারের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছি। জনগণ যেভাবে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করেছে, তাদের এবং তাদের যারা সহযোগিতা করছে, তাদের ষড়যন্ত্রকে সেভাবেই আমরা সবাই মিলে মোকাবিলা করব।’

এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মোশাররফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বলেছি অতি দ্রুত সংস্কার করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার; যাতে জনগণ একটি রোডম্যাপ পেয়ে নির্বাচনমুখী হয়ে গেলে এসব ষড়যন্ত্র আর কেউ করতে সাহস পাবে না।’

বিএনপির প্রতিনিধিদলে আরও উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং এ জেড এম জাহিদ হোসেন।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ধর্মকে ব্যবহার করে দেশে বিভক্তি সৃষ্টির পেছনে বাইরের শক্তির প্রভাব, দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো ঘটনা এভাবে অতীতে কখনো ঘটেনি। ফলে দেশের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রশ্নে এর বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য থাকতে হয়, সেটাই হয়েছে। এই সংলাপে জাতীয় ঐক্যের একটা শো আপ হয়েছে। কারণ, এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত থাকার সুযোগ নেই।

বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। বৈঠক শেষে জামায়াতের আমির সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভিন্ন মত, ভিন্ন আদর্শ—এ সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশ। একটি জায়গায় সবাই একমত হয়েছি, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কোনো ছাড় নয়।’

ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করে শফিকুর রহমান বলেন, ‘দেশের ভাবমূর্তি যারা নষ্ট করছে, তাদের বোঝাতে হবে, তোমরা আমাদের প্রতিবেশী। আমরা ভালো থাকলে তোমরাও ভালো থাকবা। জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী দিনের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে। চূড়ান্ত সফলতা অর্জন না করা পর্যন্ত আমাদের ঐক্য অটুট ও মজবুত থাকবে।’

বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় শরিক দলের সবাই অংশ নেয়। এই জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি খোলাসা করতে হবে। যেসব চুক্তি আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী, সেগুলো বাতিল করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো এ প্রস্তাব দিয়েছে। সরকারও এ বিষয়ে একমত হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে দেশের সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ আছে।’

এই জোটের নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতসহ অনেক দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে একটা অসত্যের যুদ্ধ চলছে। বলেছি, সত্য দিয়ে এই যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। সাম্প্রদায়িক উসকানির বিরুদ্ধে সব ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এই সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে।’

গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অংশীজনদের নিয়ে আগামী দুই বছরের জন্য একটি জাতীয় সরকার গঠন করা এবং দেশে স্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে আগামী ছয় মাসের জন্য সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব এসেছে।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের আত্মমর্যাদাপূর্ণ ও সাহসী পদক্ষেপের সঙ্গে দেশের সব রাজনৈতিক দল সংহতি প্রকাশ করেছে।

বৈঠকে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সিপিবির সভাপতি মো. শাহ আলম ও সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জাতীয় পার্টির (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, বাসদের উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ও যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সভাপতি মোশরেফা মিশু বৈঠকে অংশ নেন।

বৈঠকে আরও অংশ নেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির শহীদউদ্দিন মাহমুদ, বাংলাদেশ জাসদের শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধান, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ফয়জুল হক লালা, জাতীয় দলের এহসানুল হুদা, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের (একাংশ) নুরুল আমিন ব্যাপারী, ভাসানী অনুসারী পরিষদের রফিকুল ইসলাম বাবলু, খেলাফত মজলিসের আবদুল বাসিত আজাদ ও জাহাঙ্গীর হোসেন, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের আবদুর রব ইউসুফী ও মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুর রকিব, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আজম খান ও মুফতি ফখরুল ইসলাম, গণ অধিকার পরিষদের (মসিউজ্জামান) সদস্যসচিব ফারুক হাসান, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএমের ববি হাজ্জাজ, জাগপার (একাংশ) রাশেদ প্রধান, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান, জাগপার খন্দকার লুৎফুর রহমান, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (মার্ক্সবাদী) হারুন চৌধুরী, এনডিপির আবু তাহের প্রমুখ।

প্রধান উপদেষ্টা এর আগে গত মঙ্গলবারবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন । প্রধান উপদেষ্টা আজ বৃহস্পতিবার বসবেন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে।