সময়ের জনমাধ্যম

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোই পরিবেশ ধ্বংসের কারণ: ড. মুহাম্মদ ইউনূস

Last Updated on 1 day by zajira news

নিউজ ডেস্ক, জাজিরা নিউজ: জলবায়ু সংকট যখন মানব সভ্যতার ধ্বংস ডেকে আনার হুমকি দিচ্ছে, তখন পুরো বিষয়টিকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানালেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

বুধবার (১৩ নভেম্বর) আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৯) সংকট মোকাবেলার নিদান হিসেবে এই তিন শূন্যের ধারণা বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ইউনূস।

তিনি বলেছেন, মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে গ্রহণ করতে হবে ভিন্ন জীবনধারা, গড়ে তুলতে হবে ভিন্ন এক সংস্কৃতি। আর সেটা হতে পারে তার দীর্ঘদিনের লালিত ‘থ্রি জিরো’ বা ‘তিন শূন্য’ ধারণা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে।

তরুণদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান, তারা যেন তিন শূন্যের আদর্শ নিয়ে গড়ে ওঠে এবং পুরো জীবন সেই আদর্শে অটল থাকে।

বাকুতে কপ-২৯ শুরু হয়েছে মঙ্গলবার। আগের সম্মেলনগুলোতে যে প্রতিশ্রুতি বিশ্ব নেতারা দিয়ে আসছিলেন, তার বাস্তবায়ন কোন পথে হবে, সেই আলোচনা বাকুতেও ঘুরে ফিরে আসছে।

প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল, বৈশ্বিক তাপমামাত্রা বৃদ্ধির হার প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে দেওয়া হবে না। সেজন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমানো হবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলো যাতে অভিযোজনের সুযোগ পায়, সেজন্য উন্নত দেশগুলোর বছরে ১০ কোটি ডলার দেবে।

প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে জলবায়ু বিপর্যয়কে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কথা বলেন।

তিনি বলেন, “এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের শুধু মেরামত করার কথা বলবে না, বরং আমাদেরকে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য একটি নতুন পথে নিয়ে যাবে। এটা অনেক বড় কাজ, অনেক প্রশ্নও উঠবে।”

বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “জলবায়ু সংকট তীব্রতর হচ্ছে। আমরা আত্মবিধ্বংসী মূল্যবোধের প্রচার চালিয়ে যাওয়ায় আমাদের সভ্যতা গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। একটি নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের জন্য আমাদের দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক, আর্থিক এবং যুব শক্তিকে একত্রিত করা, যে সভ্যতা নিজেই নিজেকে রক্ষা করবে, নিজেই নিজের শক্তি যোগাবে।”

প্রধান উপদেষ্টার মতে, মানুষের কাজের কারণেই তাদের আবাসভূমি পৃথিবী আজ ধ্বংসের দুয়ারে পৌঁছে গেছে।

“আমরা জেনেশুনে এই ধ্বংসপ্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছি। এমন এক জীবনধারা আমরা বেছে নিয়েছি, যা পরিবেশের ক্ষতির কারণ।” বিষয়টি ব্যখ্যা করে তিনি বলেন, যে অর্থনৈতিক কাঠামো মানুষ গড়ে তুলেছে, তা কেবল সীমাহীন ভোগবাদে উৎসাহ দেয়।

“আপনি যত বেশি ভোগ করবেন, তত বেশি উৎপাদন আপনাকে করতে হবে। আপনি যদি বেশি উৎপাদন করবেন, তত বেশি অর্থ আপনি উপার্জন করবেন। আমাদের সকল কর্মকাণ্ডের মূলে রয়েছে সর্বোচ্চ লাভের ওই আকাঙ্ক্ষা, যা কি না এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমস্ত কিছুকে আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত করে।”

ইউনূসের বিশ্বাস, শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ, শূন্য দারিদ্র্য আর শূন্য বেকারত্ব অর্জনের পথ ধরে মানুষ পৌঁছাতে পারে সেই নতুন জীবনধারায়, যা আত্মবিধ্বংসী নয়, বরং নিজেই নিজের আবাসভূমিকে রক্ষা করবে।

“শূন্য বর্জ্যের নীতি মানুষের ভোগে লাগাম দেবে; যা একান্ত জরুরি, কেবল তাই মানুষ ব্যবহার করবে। তাতে কোনো বর্জ্য অবশিষ্ট থাকবে না। এটা সেই জীবনধারা, যেখানে কার্বন নিঃসরণ নামবে শূন্যের ঘরে, কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি মানুষ ব্যবহার করবে না। মানুষের চাহিদা মেটাবে কেবল নবায়নযোগ্য জ্বালানি।

“নতুন এই অর্থনীতি গড়ে উঠবে প্রাথমিকভাবে শূন্য ব্যক্তিগত লাভের নীতিতে, অর্থাৎ সামাজিক ব্যবসা হবে এর ভিত্তি। এটা সেই ব্যবসা কাঠামো যার উদ্দেশ্য থাকবে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যার সমাধান করা, ব্যবসা থেকে লাভ করা নয়। সামাজিক ব্যবসার একটি বড় অংশ নজর দেবে পরিবেশ ও মানবজাতির সুরক্ষার দিকে।

“সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের জীবন কেবল সুরক্ষিতই হবে না, গুণগতভাবেও উন্নত হবে। এ ব্যবস্থা তরুণদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার পথ খুলে দেবে। উদ্যোক্তা হওয়ার নতুন শিক্ষার মধ্য দিয়ে তরুণরা নিজেদের প্রস্তুত করবে। চাকরিপ্রার্থী তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থার জায়গা নেবে উদ্যোক্তা তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থা।”

ইউনূস বলছেন, পরিবেশের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন নতুন একটি জীবনধারা, যে জীবনধারা চাপিয়ে দেওয়া নয়, যা মানুষকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেবে। বেছে নেওয়ার সুযোগের কারণেই তরুণরা সেই জীবনধারাকে পছন্দ করবে।

“প্রতিটি তরুণ এই তিন শূন্যের নীতি নিয়ে বেড়ে উঠবে — শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ, সম্পদের শূন্য পুঞ্জিভূতকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব। সেটা সম্ভব হবে কেবল সামাজিক ব্যবসা গড়ে তোলার মাধ্যমে এবং নিজেদের উদ্যোক্তায় পরিণত করার মাধ্যমে। প্রতিটি মানুষ তিন শূন্যের নীতি নিয়ে বেড়ে উঠবে এবং আজীবন তিন শূন্যের নীতি ধারণ করবে। আর সেই পথ ধরেই এটি নতুন সভ্যতা গড়ে উঠবে।”

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জলবায়ু সম্মেলনে হাজির হওয়া বিজ্ঞানী, নীতি নির্ধারক আর অধিকারকর্মীদের উদ্দেশে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আশা করি এই স্বপ্নের পথে আপনারাও আমার সঙ্গে যোগ দেবেন। আমরা যদি একসাথে স্বপ্ন দেখি, তাহলে সেটা বাস্তব হবেই।”

প্রধান উপদেষ্টার বলেন সেজন্য মানুষকে যা করতে হবে, তা হল এই পৃথিবী এবং এর সকল বাসিন্দার জন্য মঙ্গলজনক একটি জীবনধারা বেছে নেওয়া। বাকিটা করবে তরুণ প্রজন্ম; তারা এই পৃথিবীকে ভালোবাসে।

Reendex

Must see news